জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখেছি এখনো দেখছি আমার ছেলেকে নিয়ে। আমার ছেলে অন্য দশটা ছেলের মত স্বাভাবিক না বলে অনেক অবহেলা , মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও এখন খানিকটা স্বস্তি পাই কারণ আমার ছেলে এখন ভালো ছবি আঁকে, গান করে। আমার ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তবে কর্মপ্রতিবন্ধী নয়, এমনটি বলতেছিলেন আকিবের মা শারমিন ইসলাম।
আকিব একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সে রাজধানীর মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটির ১৯৪/এ’তে অবস্থিত অটিজম কেয়ার অ্যান্ড এডভান্সমেন্ট সেন্টারে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। তবে সে অটিজম সমস্যার কারণে একজন স্বাভাবিক ছেলেদের থেকে পিছিয়ে নেই। কারণ সে বাফাতে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় পর পর ৪বার ১ম স্থান অর্জন করেছে স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
তার মা জানান, আমি প্রথম আড়াই বছর বয়সের সময় জানতে পারি যে আকিবের সমস্যা আছে। এরপর পরিবারের অন্যরা বললো যে ওকে সাইক এ নিয়ে যাও। পরে ওইখানে নিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে আকিব একজন অটিজম শিশু। এরপর তো শুরু আমাদের লড়াইয়ের জীবন। কিছু পারিবারিক সমস্যা ছিল, কিছু আচরণগত সমস্যা ছিলো ওকে নিয়ে।
শারমিন ইসলাম আরও জানান, আকিব প্রথম দিকে আমার ডাকে সাড়া দিত না। তবে ছোট শব্দ যেমনঃ মাইক্রোওয়েভের পিপ পিপ শব্দ শুনে দৌড়ে যেত, গানের আওয়াজ পেলে সেটা শুনতো। এমনকি সে হুবুহ সে গান গাইতো। আজ সে যেকোনো গান শুনে হারমোনিয়ামে তুলতে পারে। কিন্তু আমি যখন আকিব আকিব বলে ডাকতাম সে আর সাড়া দিত না।
আকিবের ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় তিনি বলেন, আমার আকিব এখন গান আর ছবি আঁকাতে পারদর্শী। প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ড করেছে সে, প্রতিবছর তার তিনটা ক্যালেন্ডার যায় ফলে সেখান থেকে সে কিছু শুভেচ্ছা টাকা পায়। এছাড়া সে গত ২০১৬ সালে পি এস সি পরীক্ষায় ‘এ’ গ্রেট পেয়েছিল। আর ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে ওকে মিউজিক কলেজে ভর্তি করার যদি আমাদের বাচ্চাদের মিউজিক কলেজে বা আর্ট কলেজে ভর্তি করার সুযোগ দেয় সরকার। শুনেছি সরকার নাকি এটার অনুমতি দিছে তবে এখনো সেটা কার্যকর হয়নি। কিন্তু ওরা ভালো গান করে ওরা ভালো ছবি আঁকে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা সেটা তাদের আছে তবে সমস্যাটা হয়ে যায় ওরা অন্য দশজনের মতো না। যদি বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে ভর্তি হওয়ার জন্য সু্যোগ করে দেয় তাহলে আমার মতো হাজারো আকিবের মায়ের স্বপ্ন পূরণ হবে।
এরপর স্কুলটা ঘুরে দেখার সময় আরেক অভিভাবক রাশিদা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তার ছেলে আদর (১৮) একই স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র।
তিনি জানান, আমার যে বাচ্চা সে একজন স্পেশাল চাইল্ড। তাকে বা তাদেরকে সাধারণ মানুষের সাথে তুলনা করলে হবে না। একটা ছোট্ট উদাহরণ বলি আপনাকে সেটা হলো আমরা যদি কোথাও ঘুরতে যাই সেখানে দেখা যায় আমার বাচ্চাটা অন্য দশ জনের মতো চলতে পারছে না, গাড়িতে উঠতে পারতেছে না। অনেক সময় তাকে আমি গণপরিবহনে উঠিয়ে দিতে পারলেও আমি উঠতে পারি না এসময় কেউ একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না। সেটা না বাসের হেল্পার না বাস চালক। এছাড়া তো পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা তো আছেই।
তিনি আরও বলেন, পারিবারিকভাবে আমি অনেক আঘাত পেয়েছি। যেমনঃ একদিন আমি আমার ছেলেকে নিয়ে তার ফুফুর বাসায় গেলে তার ফুফু অভিযোগ জানায় যে আমার ছেলে নাকি তার ফুলদানিটা ভেঙে দিয়েছে কিন্তু আদৌ সে ভাঙেনি। এছাড়া তারা সবাই কর্তব্যে খাতিরে আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিত কিন্তু তারা চাইতো না আমরা সেখানে যাই। তারা শুনতে চাইতো আমরা সেখানে যাবো না সেই কথাটা।
রাশিদা আক্তার বলেন, আমাদের বাঁচ্চারা সমাজের বোঝা না। তাদের হয়তো ৫টি ইন্দ্রিয়ের যেকোনোটার সমস্যার কারণে অন্যসবার মতো স্বাভাবিক আচরণ করে না কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখেন তারা একজন স্বাভাবিক মানুষের থেকে গুনগত দিক দিয়ে ভালো কাজ করে।
তবে আমার ছেলের যতটুকু উন্নতি হয়েছে সেটার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের অবদান অনেক বেশি।
প্রতিবন্ধী এই শিশুদেরকে নিয়ে কথা হয় অটিজম কেয়ার অ্যান্ড এডভান্সমেন্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান আবুল মুনসুর আজাদের (জাফর) সাথে।তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। এ পর্যন্ত আমার প্রতিষ্ঠানে রেগুলার ২৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ডেইলি বেসিসে আছে ৬ জন এবং প্যাকেজে আছে আরও কিছু শিক্ষার্থী।
প্রথমদিকে এই স্কুল শুরু করা নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়েছি। কেউ যদি শোনে প্রতিবন্ধীদের স্কুলের জন্য একটা বিল্ডিং ভাড়া নিতে এসেছি তখন অনেকেই তাড়িয়ে দেয়। তারা বলে এখানে ওইসব স্কুলের জন্য ভাড়া দিবো না। এছাড়া যারা দেয় তারাও অনেক সময় ঝামেলা করে।
তবে এসব বাঁচ্চাদের জন্য যদি এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় যে সেখানে খোলা মাঠ আছে, হাঁটার জন্য জায়গা থাকে এমনকি সাঁতার কাটার জন্য স্যুইমিং পুল থাকে সেটা তাদের জন্য উত্তম জায়গা।
তারাও অনেকটা সুস্থ্য মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারে যদি আমরা তাদেরকে সেই পরিবেশটা দেই এবং আমরা যদি তাদেরকে একজন সুস্থ্য মানুষের সাথে যেভাবে মিশি তাদের সাথেও সেভাবে মিশি তাহলে তারাও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, অটিজম শিশুদের প্রধান সমস্যাটা হলো তাদের কমিউনিকেশনে সমস্যা হয়। একটা অটিজম শিশু তখনই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে যদি স্কুল, বাসা এবং সমাজ এই তিনটা ক্ষেত্র যদি তাকে মেনে নেয়।
স্কুলটি নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে আবুল মুনসুর আজাদ বলেন, আমাদের যদি একটা নিজস্ব ভবন থাকতো তাহলে অনেক রকম থেরাপি আছে সেগুলা আমি দিতে পারতাম। এছাড়া স্কুলে যদি পর্যাপ্ত খেলার জায়গা থাকতো তাহলে তাদেরকে একটা খেলাধুলা করার পরিবেশ দিতে পারতাম। তবে আমি স্বপ্ন দেখি এইসব শিশুদের জন্য আমি আমার স্কুলে আগামীতে আরও ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবো বলে আশা করি।