প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭২তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল ‘হাসিনা : অ্যা ডটার’স টেল’ শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রের ট্রেলার। তখন থেকেই এটিকে ঘিরে সকলের তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়। আজ (১৬ নভেম্বর) মুক্তি পেয়েছে বহুপ্রতীক্ষিত এই প্রমাণ্যচিত্রটি।
জানা যায়, স্টার সিনেপ্লেক্সের পাশাপাশি ঢাকার মধুমিতা সিনেমা হল ও ব্লকবাস্টার সিনেমা’স এবং চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে একযোগে মুক্তি পেয়েছে ৭০ মিনিট ব্যাপ্তির এ ডকুফিল্ম।
শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সন্তান কিংবা যোগ্য নেত্রী নন, তিনি একজন মমতাময়ী মা। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও পরিবারের কাছে তিনি সাধারণ হয়ে থাকতে পছন্দ করেন। আর তাই টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভ্যানগাড়িতে ঘুরে বেড়ান, নাতনিদের চুলে বেনী করে দেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করেন, ছেলের জন্মদিনে বা সুযোগ পেলেই রান্না করেন, পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
দুস্থ মানুষের সেবায় এক নিবেদিত প্রাণের নাম শেখ হাসিনা। তার সব মানবিক দিকগুলো এবার বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয়েছে। সেখানেই জানা যায়, ‘অলস প্রকৃতির’ শেখ হাসিনা কিভাবে বাবা-মা’সহ স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেছেন।
ছোট বেলায় কিছুটা ‘অগোছালো প্রকৃতির’ ছিলেন শেখ হাসিনা। পরিবারের সদস্যদের কাছে তার রুম ‘আলসেখানা’ নামেই পরিচিত ছিলো। নিজের কক্ষে নিবিষ্ট থেকে গান শুনতে আর বই পড়তেই পছন্দ করতেন তিনি। তবে তার ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন মা ফজিলাতুন নেসা মুজিবের মতো সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী।
সেই স্মৃতি হাতরিয়ে শেখ রেহানা বলেন, ‘বাবার সঙ্গে মাকেও হারিয়ে একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলাম। পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়ে কষ্টের জীবন পার করতে হয়েছে। আমার খুব করে মন চায়, আজ মাকে যদি বলতে পারতাম তোমার হাসু আর আলসেখানায় থাকে না। বনানী কবরস্থানে গিয়ে ভাবি, যদি তাকে এখনও চিঠি লিখতে পারতাম!’
জীবনের চরম কঠিন এসব ঘটনার সঙ্গে কিছু মজার স্মৃতিও প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নৌকায় চড়ে তার প্রথম ঢাকায় আসার অভিজ্ঞতা, রান্না শেখাসহ নানা অজানা ঘটনা ধরা দিয়েছে সেলুলয়েডে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা প্রথম ১৯৫২ সালে ঢাকায় আসলাম। নৌকায় করে আসছিলাম ঢাকায়। তিন মাল্লার নৌকা। নৌকার ভেতরে রান্না হত, নৌকার ভেতরে থাকা যেত। বড় থাকায় আমরা দৌড়াদৌড়িও করতে পারতাম। নৌকায় চড়ে ঢাকায় আসতে সে সময় চার দিন সময় লেগেছিল।’
টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে-ফিরে আনন্দে বেড়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। বাড়ির পাশের খালে ঝাঁপাঝাপি করেছেন। এখনো সেসব স্মৃতি তার হৃদয়ে গাঁথা। তাই নিজের মনের গোপন ইচ্ছার কথাও প্রামাণ্যচিত্রে প্রকাশ করেছেন জননেত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কাছে টুঙ্গিপাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্থান। গ্রামে ঘুরতাম, ফিরতাম। খালে ঝাঁপ দিয়ে বেড়াতাম। রাজনীতি থেকে অবসরে গেলে আবার টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে ফেরার ইচ্ছার কথাও ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
প্রামাণ্যচিত্রে শেখ রেহানার জবানিতে শেখ হাসিনার উপর ২০০৪ সালে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তুলে ধরা হয়। সেদিন তার বাসায় অতিথি এসেছিল। তাদের জন্য আতিথেয়তার আয়োজনের মধ্যে টেলিভিশনে ওই খবর দেখেন তিনি। শেখ রেহানা বলেন, ‘প্রথমে শুনি আপা নাই। একবার এক রকম খবর শুনি। পরে দেখি আপা গাড়িতে। তার পুরো শরীরেও রক্ত।’
১৯৭৫ সালের ১৪ অগাস্ট রাতে ইউরোপে ‘ক্যান্ডেল লাইট’ ডিনারে উল্লাসে মেতে থাকলেও পরদিন বাবা-মা’সহ পরিবারের সবাইকে হারানোর খবরে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা।
রেহানা বলেন, ‘আমাদের প্রথম ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, আমরা খুব আমোদ-ফুর্তি করছিলাম। দুলাভাইয়ের ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছিল। তিনি ঠাট্টা করে বলছিলেন, এত আনন্দ কইরো না, এর ফল ভালো হয় না। তার কথাটাই মনে হয় ঠিক হয়ে গেছে।’
টেলিফোনে পরিবারের সবাইকে হত্যার খবর পেয়ে মুষড়ে পড়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই টেলিফোন আওয়াজের মতো কর্কশ সাউন্ড বোধহয় আর নাই। সেই আওয়াজ এখনও যেন মনে বাজে।’
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর যুবলীগের নূর হোসেন শহীদ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গও প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘নূর হোসেন ছেলেটা আমার গাড়ির কাছে এসেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, এই ছেলে তুমি যেটা লিখছো, এটা দেখলে তোমাকে মেরে ফেলবে। সে বলল, আপনি আমার মাথায় হাত রাখেন, আমি প্রয়োজন হলে জীবন দিয়ে দিব।’
কিছুক্ষণ পরই বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার গাড়িটা গোলাপ শাহ মাজারের দিকে গেলে পুলিশ আটকে দেয়। গাড়ি থেকে দেখি নূর হোসেনকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছেলেটির কথাই যেন ঠিক হল।’
গণভবনে শেখ হাসিনার রান্নার ভিডিও দিয়ে শুরু হওয়া এই প্রামাণ্যচিত্রে নিজের রান্না শেখার কাহিনীও শোনান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পরও আমি তেমন রান্না-বান্না করতাম না। মা অনেক ভালো রান্না করতে পারতেন। আমার বাসায় মেহমান আসলে মাকে জানাতাম, তিনি সব খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন।’ তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দিল্লিতে নির্বাসনের সময় ‘উপায় না থাকায়’ রান্না শিখেছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা।