গত ৮ থেকে ৯ বছরে সংঘবদ্ধ চোর চক্রটি প্রায় পাঁচ শতাধিক চুরি করেছে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতা ইসমাইল খানসহ চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। তারা রাজধানীর হাতিরঝিল, রামপুরা, তেজগাঁও, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, রূপনগর, কাফরুল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল এলাকায় পাঁচ শতাধিক চুরিতে জড়িত। হাতিরঝিল থানার নিউ ইস্কাটনের একটি চুরি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এই চক্রের প্রধান চার সদস্যকে বিপুল পরিমাণ চোরাই মালামালসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ. এম আজিমুল হক।
তিনি বলেন, চলতি বছরের মে মাসে হাতিরঝিল থানায় হওয়া মামলা নম্বর-৬ ধারা-৪৫৪/৪৫৭/৩৮০ পেনাল কোড তদন্ত করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর এই চোর চক্রের সন্ধান মেলে। হাতিরঝিলের নিউ ইস্কাটনে অবস্থিত একটি ভবনের সপ্তমতলায় সপরিবারে থাকেন তৌহিদুল ইসলাম। গত ৩০শে এপ্রিল ঈদের ছুটিতে নরসিংদীর মনোহরদীতে গ্রামের বাড়িতে যান। পাঁচদিন পর তার স্ত্রী ঢাকায় ফিরে বাসার দরজা খুলে দেখেন বাসার সব রুমের মালামাল এলোমেলো। মাস্টার বেডরুম ও অন্য রুমের তিনটি আলমারির তালা খোলা এবং রান্নাঘরের পাশের জানালার গ্রিল কাটা। আলমারির ভেতরে রাখা নগদ টাকা, স্বর্ণের গহনা ও বিদেশি ব্র্যান্ডের ঘড়িসহ প্রায় সাড়ে বারো লাখ টাকার বেশি মালামাল চুরি হয়েছে।
পরবর্তীতে তারা এ বিষয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন।
মামলার তদন্তে দেখা যায়, ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে স্থাপিত একটি সিসি ক্যামেরার অস্পষ্ট ফুটেজে মাস্ক ও ক্যাপ পরিহিত একজনকে ব্যাগ হাতে সিএনজিযোগে চলে যাচ্ছেন। সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্য প্রযুক্তিগত সহায়তায় বুধবার সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জের কুলচর এলাকা থেকে ইসমাইল খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে নিউ ইস্কাটনের বাসা থেকে চুরি হওয়া দুটি ঘড়িসহ স্বর্ণ ও হীরা যাচাই করার যন্ত্র, স্বর্ণ পরিমাপের যন্ত্র, ক্যামেরা, চোরাই মোবাইল, ৩ কেজি পরিমাণ বৈদেশিক ধাতব মুদ্রা, ডলার, রিয়েল, কুয়েতি দিনার, রিংগিতসহ বৈদেশিক মুদ্রা ও অত্যাধুনিক গ্রিল কাটার মেশিন উদ্ধার করা হয়।
ডিসি আজিমুল বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল খানের স্বীকারোক্তিমূলক তথ্যের ভিত্তিতে চুরিতে জড়িত অপর দুই চোর ফাহাদ হোসেন কমলকে ঢাকার রূপনগর থেকে এবং আরিফ হোসেনকে কাফরুল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে চোরাই মোবাইল ফোন, হাতঘড়ি, বৈদেশিক মুদ্রা, ছোট টর্চলাইট, চুরির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং স্বর্ণ মাপার যন্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত তিনজন গোপাল ঘোষের কাছে শতাধিকবার চোরাই স্বর্ণ বিক্রি করেছে বলে স্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল এলাকায় গ্রিলকাটা ও বাসার দরজার তালা ভেঙে চুরির একটি ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। যে চক্রে কাজ করে আরও ২০ জন। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই চক্রটি ঢাকার মিরপুর, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, লালবাগসহ চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল এলাকায় পাঁচ শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল খান প্রাথমিকভাবে দেয়াল ও গ্রিল বেয়ে উঠে বহুতল ভবনের টার্গেটকৃত ফ্ল্যাটের গ্রিল কেটে ভেতরে প্রবেশ করে চুরি করে। দেয়াল ও গ্রিল বেয়ে ৮-১০ তলা ভবনের উঠার বিশেষ দক্ষতার কারণে সে চোর চক্রে ‘কালো মাকড়সা’ নামে পরিচিত। আরিফ হোসেন দরজার তালা ভাঙতে দক্ষ। ফাহাদ হোসেন কমল চুরির স্থান থেকে সামান্য দূরে মোটরসাইকেল নিয়ে চুরির পর নিরাপদে বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করার পাশাপাশি পুলিশের গতিবিধি খেয়াল করে।
এই চক্রের অন্য ২০ জন সদস্য মূলত বিভিন্ন এলাকায় চুরি করার মতো সম্ভাব্য বাসা, ফ্ল্যাট সম্পর্কে গ্রেপ্তারকৃত তিনজনকে তথ্য দেয়। কিন্তু চুরির সময় তারা ঘটনাস্থলে থাকে না। তারা সন্ধ্যার পর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে যে সকল বাসা-ফ্ল্যাটের লাইট বন্ধ দেখেন সেই বাসাকে সম্ভাব্য টার্গেট হিসেবে ধরে গ্রেপ্তারকৃতদের জানিয়ে দেয়। পরে এই তিনজন সুবিধাজনক সময়ে গ্রিল কেটে, দরজার তালা ভেঙে চুরি করে। গ্রেপ্তারকৃত তিনজন বাকি ২০ সদস্যকে তাদের বিকাশ, রকেট ও নগদ অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা পাঠায়। এই চক্র ঢাকাসহ যেসব এলাকায় চুরি করেছে সেই স্থানগুলো শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরআগে আসামি ইসমাইলের বিরুদ্ধে ৪টি, আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে ২টি ও ফাহাদ হোসেন কমলের বিরুদ্ধে মোট ৪টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।