Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

শিশুর ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কী কী ও কখন হাসপাতালে নেবেন?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:১২ AM
আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:১২ AM

bdmorning Image Preview


ডা. সেলিনা সুলতানা

দেশে বাড়ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। এতে মৃত্যুও হচ্ছে অনেকের। বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি মোট ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১২৮ জন।

বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীরাই কখন ও কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাবেন তা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। ফলে চিকিৎসা নিতে দেরি হয়ে যায় বেশিরভাগেরই। রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যায়। তাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে বা বিশেষ করে শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর হলে কোন কোন লক্ষণ দেখলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাবেন তা জানা জরুরি।

সর্বপ্রথম ডেঙ্গু ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন ১৯৪৩ সালে রেন কিমুরা ও সুসুমু হোত্তা। প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন তারা। এই দুই বিজ্ঞানী জাপানের নাগাসাকিতে ১৯৪৩ সালে মহামারির সময় রোগীদের রক্তের নমুনা নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন।

ডেঙ্গু জ্বর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে একটি সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ, যা মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শহরাঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বর বেশি দেখা যায় তার কারণ হলো অনেক মানুষের আগমন, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও বাড়ি নির্মাণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে মানুষ ও মশার চলমান ভ্রমণের ফলে শহরে ডেঙ্গু জ্বর ৩০ গুণ বেড়েছে। ১৯৬০-২০২২ সালের মধ্যে শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৩-১৪ দিন পরে শুরু হয়। উচ্চ মাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশি, জয়েন্টের ব্যথা ও ত্বকের ফুসকুড়ি ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো সাধারণত ২-৭দিন স্থায়ী হয়। বেশিরভাগ মানুষই এক সপ্তাহ পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

তবে গুরুতর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আবার মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হয়, যেখানে প্লাজমা লিক, তরল জমা, শ্বাসকষ্ট, মারাত্মক রক্তপাত বা অঙ্গ দুর্বলতার কারণে রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে।

ফলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে, অনেক সময় এর থেকে মৃত্যুও হতে পারে। এক্ষেত্রে সতর্কতামূলক কিছু লক্ষণ যেমন- তীব্র পেটে ব্যথা, ক্রমাগত বমি, শ্বাসকষ্ট ও অস্থিরতা দেখলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে রোগীকে।

সাধারণ ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ১ শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়, অন্যদিকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ২.৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের চিকিৎসা না করা হয় তাহলে মৃত্যুহার ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ ও লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বরের ফেইজগুলো সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম হলো- ফেব্রাইল বা জ্বরের ফেইস, যা ২-৭ দিন স্থায়ী হয়। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা হঠাৎই বেড়ে যায়। ২-৫ দিনের মধ্যে শরীরের বেশিরভাগ অংশে লাল ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।

দ্বিতীয় হলো, ক্রিটিক্যাল ফেইস যা ৪৮-৭২ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। জ্বর খুব একটা থাকে না, কিন্তু রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রক্ত কণিকার মধ্যে শ্বেত কণিকা ও অনুচক্রিকা কমে যায়। হেমাটোক্রিট (রক্তের হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব) বেড়ে যায়। তৃতীয় ও শেষটি হলো কনভালোসেন্ট বা রোগ থেকে উন্নতি হওয়ার পর্যায়।

সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে জ্বর থাকে সাধারণত ২-৭দিন পর্যন্ত। উপসর্গের মধ্যে বমি বমি ভাব, খাওয়ার অরুচি, শরীরের বিভিন্ন জায়গার অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা, মাথা ব্যথা অনুভূত হয়। এজন্য একে বলা হয় হাড্ডি ভাঙ্গা জ্বর।

মাঝারি অবস্থায় অর্থাৎ চতুর্থ দিনে শরীরে ফুসকড়ি দেখা যায়। এর সঙ্গে তীব্র পেটব্যথা, বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, হাত পা ছেড়ে দেওয়া, রক্তের অনুচক্রিকার মাত্রা অতিরিক্ত মাত্রায় কমে যাওয়া, রক্ত বমি হওয়া, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত, কালো পায়খানা এগুলো তীব্র ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ বলে গণ্য হয়। এক সময় রক্তপাত বেশি মাত্রায় হয়, প্লাজমা লিকেস বা রক্ত রস বেরিয়ে পেটের মধ্যে জমে, ফুসফুসে পানি জমে যার ফলে শ্বাসকষ্ট হয়।

মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ও অঙ্গ যেমন- লিভার ও কিডনির ক্ষতি করতে পারে। রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে, যার ফলে শক হয়। মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুও হতে পারে। যেসব নারীরা গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন, তাদের প্রসবের সময় শিশুর মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা কী?

সাধারণ ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে বলা হয় ২-৩দিন অপেক্ষা করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে জ্বর আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে চিকিৎসক বাড়িতে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। সঙ্গে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল সিরাপ দেওয়া হয় বয়স ও ওজন অনুযায়ী।

প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ানোর জন্য বলা হয় শিশুকে। এরপর চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষার জন্য উপদেশ দেন ও ৩ দিন পর আসতে বলেন যদি না অন্য কোন উপসর্গ চলে আসে। মাঝারি বা তীব্র ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে দেখা যায় রক্তচাপের পরিমাণ কমে যায়, প্লাজমা লিকেজ হয়, বাচ্চার মধ্যে অস্থিরতা ও খেতে না পারার লক্ষণগুলো চলে আসে।

সাধারণত ইন্ট্রাভেনাস হাইড্রেশন প্রয়োজন হয় ২/১ দিন। এ সময় চিকিৎসকরা রক্তচাপ, ভাইটাল সাইন ও হেমাটোক্রিট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। যেখানে আই সি ইউ ও হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট থাকবে সেসব হাসপিটাল বেছে নেওয়া ভালো।

ওষুধ ও স্যালাইনের মাধ্যমে শিশু অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। যেহেতু এটি ভাইরাসবাহিত রোগ তাই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রক্তক্ষরণ বেশি হলে তার জন্য প্রয়োজনে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অ্যান্টি বায়োটিকের খুব বেশি দরকার হবে না যদি না শিশুর মধ্যে অন্যান্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন থাকে যেমন- নিউমোনিয়া, বুকে ইনফেকশন, প্রসাবে ইনফেকশন ইত্যাদি।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয়

শিশুরা যেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত না হয় তার প্রতিরোধে আসলে আমাদের করণীয় দুটি উপায় আছে। একটি হলো টিকা দেওয়া ও অন্যটি বাহকের বিস্তার রোধে। টিকা বা ভ্যাকসিন বহির্বিশ্বে চলে এসেছে। আমাদের দেশে এখনো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। এজন্য মশার বিস্তার রোধে প্রথম গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

শিশুকে সব সময় মশারির মধ্যে ঘুম পাড়াতে হবে। এ সময় শিশুদের ফুলহাতা জামা কাপড় পরিয়ে রাখাটাই ভালো। বাজারে এখন বিভিন্ন ধরনের মশা কামড় নিরোধক ক্রিম পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করতে হবে।

সর্বোপরি বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন, ফুলের টব, টিন, বোতল, নারকেলের খোলস ইত্যাদিতে যেন পানি না জমতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন। ফ্রিজ বা এসির পানি যাতে না জমে সেটার ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নির্ভর করে সরকারি পর্যায়ে বা সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থার উপর।

লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল

Bootstrap Image Preview