Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

উদাসীন পরিবারে বেপরোয়া সন্তান: পুলিশও অসহায়, কাজে আসছে না মুচলেকা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ জুলাই ২০২২, ০৮:২০ AM
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২২, ০৮:২০ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে শিক্ষার্থী নামধারী একশ্রেণির কিশোর অপরাধী। পরিবার, শিক্ষক, এলাকার মুরুব্বি-কাউকেই মানছে না তারা। অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। জড়াচ্ছে একের পর এক অপরাধে। এমনকি শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করছে না। গেল সপ্তাহে এমনই এক বখাটে ছাত্রের হাতে শিক্ষকের নির্মম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা শিক্ষকদের মধ্যে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। ভীতি ছড়াচ্ছে তাদের পরিবারেও।

অপর দিকে এ ধরনের বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশও অসহায় হয়ে পড়েছে। সাধারণত অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত কিশোরদের থানায় ডেকে এনে সতর্ক করা হয়। প্রয়োজনে ডেকে আনা হয় অভিভাবকদের। নেওয়া হয় মুচলেকা। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। ফের একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। বিপথগামী সন্তানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় অভিযোগও করেছেন অনেক মা-বাবা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকরণ এ অবস্থার জন্য বহুলাংশে দায়ী। ছাত্ররা ক্লাসে আসে না। শিক্ষকরা তদারকি করলে তাদের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়। এছাড়া অনেক অভিভাবকের মধ্যেও চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। যার সন্তান যত বড় সন্ত্রাসী, সে যেন তত বেশি আনন্দ অনুভব করে। শিক্ষকদের শাসনকে তারা ‘সম্মানে আঘাত’ হিসাবে নেয়।’ তিনি মনে করেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রথমত নৈতিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকা ঘিরে প্রায় অর্ধশত ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এদের রয়েছে শক্ত প্ল্যাটফরম। ওবারলো ডটকমের এক পরিসংখ্যান বলছে, টিকটকের ৪১ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শিক্ষকদের নিপীড়নের অধিকাংশ ঘটনার পেছনে এই বয়সিদের বেশি সম্পৃক্ততা পেয়েছে। গত অর্ধযুগে কিশোর গ্যাং এবং এই সংশ্লিষ্ট অপরাধের দায়ে দেড় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের বড় একটি অংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, নেশা, শোডাউন, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে গ্রেফতার হয়েছে তারা। আর এসব অপরাধের অর্থ জোগাতে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরিসহ নতুন অপকর্মে জড়াচ্ছে কিশোরদের বড় একটি অংশ। এলাকায় দাপট ‘জানান দিতে’ ঘটছে খুনের ঘটনাও। তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, ছুরি, চাপাতি, ড্যাগার, রামদা, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। বেশির ভাগ সময়েই ১৮ বছরের কম বয়সি হওয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আসছে না তারা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সর্বশেষ জিতুসহ অনেকের বয়স ১৮ বছরের বেশি হওয়া সত্ত্বেও কিশোর দেখানো হয়েছে। এর পেছনেও সমাজের অনেকের ভূমিকা থাকে।

সর্বশেষ ঘটনায় ছাত্রের স্টাম্পের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে ২৭ জুন সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় অভিযুক্ত স্কুলছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতুর ইভটিজিং, স্কুলের ভেতরে ধূমপান, স্কুল কম্পাউন্ডে বেপরোয়া বাইক চালানোসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ছিল নিয়মিত ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাকে কিছু বলার সাহস পেতেন না শিক্ষকরা। সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অসংখ্য জিতু রয়েছে। কিন্তু খুব অল্প সময়ই তাদের দ্বারা শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনাগুলো সামনে আসছে। তবে যে কোনো বড় ঘটনার পরই জানা যাচ্ছে, সেখানে এর আগেও এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধ যারা করছে, তাদের ওপর কিশোর গ্যাংয়ের প্রভাব আছে। আমরা নিয়মিত তাদের বিষয়ে তথ্য রাখছি। অনেককে থানায় আনা হচ্ছে। সেখানে অভিভাবকদের ডেকে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে। মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের হাতে সন্তানকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করছি। কিন্তু খুব বেশি যে কাজে লাগছে, সেটাও দাবি করতে পারি না। কারণ থানা থেকে বের হওয়ার পর দেখা যায়, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশে একই কাজ করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপরও যদি কোনো ছাত্র সহপাঠী ছাত্রী বা শিক্ষকদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে খারাপ আচরণ করে, সেক্ষেত্রে থানা পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।

সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনাগুলো বাড়ছে বলেও মনে করেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন শিক্ষকদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও সাহস পেতাম না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেও উপাচার্য স্যারের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যেতে সাহস পেতাম না। আর এখন শিক্ষকরা যেন ছাত্রদের ভয়ে থাকে। যদি শ্রদ্ধার জায়গাটা না থাকে, তাহলে কেবল আইন দিয়ে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ তবে তিনি মনে করেন, ‘এখানে শিক্ষকদেরও দায় আছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো শিক্ষকের কাছে পড়লে শিক্ষার্থীকে ভালো নম্বর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু না পড়লে ফল খারাপ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন অনৈতিক আচরণ অপ্রত্যাশিত।’

ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমাদের সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় এবং নৈতিকতার অভাব, সেটা তো বিচ্ছিন্নভাবে দূর করা কঠিন। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব গিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে।’ এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিবারের বৈধ আয়, নৈতিক চর্চার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন পুলিশের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি সন্তান হঠাৎ করেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে না। এর পেছনে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার অনেক দায় রয়েছে। সমাজের প্রভাবশালীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে আধিপত্য বিস্তার এবং এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সেখানে আলাদা নজর রাখছেন। অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোয় অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছেন। এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসাবে উঠতি বয়সি শিক্ষার্থীদেরও বেছে নিচ্ছেন, যা শিক্ষকদের জন্য ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।

এ অবস্থার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল শিক্ষকদেরও দায় দিতে চান। তিনি মনে করেন, একশ্রেণির শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ধরনা দিয়ে মর্যাদা হারিয়েছেন।’

এদিকে অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিক্ষক নির্যাতনসহ কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলোর নেপথ্যে অনেক সামাজিক অসংগতি রয়েছে। এই ধরনের অপরাধের মূল কারণ-দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, অর্থলোভ, ‘স্ট্যাটাস ফ্রাস্ট্রেশন’ এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা। এসব ঘটনার জন্য পরিবারের দায় সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের সন্তান শিক্ষকের গায়ে হাত দিচ্ছে-এমন পর্যায়ে এলো কীভাবে?

কিশোর অপরাধের এই ধারা এবং এর প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া, আকাশ সংস্কৃতি ও মডার্নাইজেশন এসব অপরাধের অন্যতম কারণ। এখনই এসব সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের কিশোর সংশোধনকেন্দ্রগুলোয় কোনো কাজ হয় না বললেই চলে। এগুলো গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি কিশোরদের বেশি করে ‘ভলান্টারি’ কাজে যুক্ত করতে হবে। খেলাধুলার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি যত্নবান হতে হবে। রাখতে হবে কঠোর মনিটরিংয়ে। এর কোনো বিকল্প নেই।’

সূত্রঃ যুগান্তর

Bootstrap Image Preview