Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কামালের ব্রিফকেসে মধ্যবিত্তের জন্য কী থাকছে

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯ জুন ২০২২, ০৪:১০ AM
আপডেট: ০৯ জুন ২০২২, ০৪:১০ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


করোনা মহামারির চরম অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাজারে চাল, ডাল, আটা, ডিম, তেলসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। চাপ পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর। আবার ডলার সংকটে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মধ্যে আছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতিপথকে ব্যাহত করছে। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬.২৯%, যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হচ্ছে আজ। যাতে ভর্তুকি খাতে ব্যাপক বরাদ্দ বাড়ছে বলে জানা গেছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আজ বেলা ৩টায় মহান জাতীয় সংসদে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শীর্ষক শিরোনামে এবারের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট এটি।

 

আগামী বাজেটে প্রাধিকার পাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে। এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা খাতসহ বেশকিছু খাতকে।

বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সক্ষমতা উন্নয়নের এই বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। মেগা এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। জিডিপি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফলে আগামী বাজেটে ঘাটতি (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অপরদিকে আগামী বাজেটে সরকারের ব্যয় নির্ধারণ করা হচ্ছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়/বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটছে। সেজন্য আমদানিকৃত পণ্যে বেশি করে ভর্তুকি দেয়া হবে। বিশেষ করে সার, খাদ্যপণ্য, বিদ্যুৎ, রপ্তানি পণ্য ও রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ব্যয় করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায় সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আগামী বাজেটে করহার বাড়ানো হচ্ছে, যা বড় একটি প্রাপ্তি। নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করে কর আদায় বাড়ানো হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, আগামী বাজেটের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১.৫ শতাংশ, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি ৬.৬ শতাংশ এবং বেসরকারি ২৪.৯ শতাংশ। মোট রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে জিডিপির ৯.৮ শতাংশ, মোট ব্যয় জিডিপির ১৫.৪ শতাংশ, মোট ঘাটতি জিডিপির ৫.৫ শতাংশ এবং প্রাথমিক ঘাটতি জিপিডির ৩.৭ শতাংশ। আর আগামী বাজেটে জিডিপির আকার হবে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বড় কারখানাগুলোতে সহায়তার ক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে চমক থাকবে। যারা অন্যান্য দেশে পণ্য তৈরি ও বিক্রি করতে সক্ষম তাদেরকে সহায়তা করা। আমরা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যের প্রচারে অগ্রাধিকার থাকবে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। 
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে অবৈধভাবে বিদেশে নিয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিতে পারে সরকার। যারা ট্রেড আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ নিয়ে গেছেন তারা জরিমানা হিসাবে ৭ শতাংশ কর দিয়ে তা ফিরিয়ে আনার সুযোগ পেতে পারেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা। 

সূত্র মতে, বাজেটে করহার বাড়ছে না। তবে আওতা বাড়াতে থাকবে বেশকিছু নির্দেশনা। এ ছাড়া রাজস্ব ও রপ্তানি বাড়াতে কিছু কিছু খাতে করছাড় দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটা চমক হলো পোশাক খাতের মতো সব রপ্তানি খাতে করপোরেট কর ১২ শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমানে এই হার ২২.৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩০ শতাংশ। 
আর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ আছে, তা আগামী অর্থবছরে বহাল রাখা হচ্ছে না।

ভ্যাট বাড়ছে: জানা গেছে, কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এটি বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাজারে ফ্রিজের দাম বাড়তে পারে। পাশাপাশি মোবাইল সেট বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট নেই। ব্যবসা পর্যায়ে মোবাইল সেটের ওপর বাড়িয়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে মোবাইলের দাম বাড়তে পারে। 

ভ্যাট কমতে পারে: কয়েকটি খাতে ভ্যাট হার কমানো হচ্ছে। এর মধ্যে হোটেল-রেস্টুরেন্টের ভ্যাট কমানো হচ্ছে। বর্তমানে এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ১০ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। আসন্ন বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অপরদিকে, জুয়েলারি শিল্পের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। ভ্যাট রিটার্ন দাখিলে (দাখিলপত্র) ব্যর্থতার জরিমানা ১০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। আর ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা ও অনিয়মের ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে।

সূত্র মতে, আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়। 

২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬.৪৪ শতাংশ হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে ৫.৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি রাখার প্রত্যাশা নিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে আগামী বাজেট। নিয়ন্ত্রণমূলক মূল্যস্ফীতির জন্য বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ব্যাপক হারে।

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, দেশে সাড়ে ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপীয় দেশের মতো। তবে এই ৫ কোটি মানুষের বাইরে যারা আছেন তারা অতিকষ্টে জীবনযাপন করছেন মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজেট বক্তব্যের খসড়ার সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে চাহিদাকৃত পণ্যের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে এবং এর কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপে আছে মানুষ। বাজেটীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার এই মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রা ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায়।

মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের একটি অংশ আবার গরিব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। এবার প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসে সরকারি সংস্থা বিবিএস দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ৪৭টি পণ্যের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ওই সব বহুল ব্যবহৃত ৪৭টি পণ্যের মধ্যে এপ্রিল মাসে ৩২টির দাম বেড়েছে। এপ্রিল মাসে দাম কমার তালিকায় ডিম থাকলেও এখন ডিমের দাম আবার চড়া। ফলে পদে পদে মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভব করছেন সাধারণ মানুষেরা। মূল্যস্ফীতি গণনায় একক পণ্য হিসেবে চালের অবদান সবচেয়ে বেশি। এই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চাল কেজিতে ৩ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বাজেটে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতের কর্মসূচিগুলোর বরাদ্দ ও কভারেজ দুটোই বাড়াতে হবে। অনেক মানুষের চাকরি চলে গেছে, অনেকে অনানুষ্ঠানিক কাজের সুযোগও হারিয়েছে, আয় কমে গেছে অনেকের। এর ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের ভেতরেই বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করার মতো বাজেটে উদ্যোগ থাকতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণীত বাজেট বক্তব্যের চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাজেটে এই অগ্রাধিকার পদক্ষেপগুলো থাকতে পারে। সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি; প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন সম্পন্নকরণ; অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা; ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন; শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন; সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ; নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে খাদ্য বিতরণ।

বাজেটকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট www.mof.gov.bd-এ বাজেটের সব তথ্যাদি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারবে এবং দেশ বা বিদেশ থেকে ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফরম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ প্রেরণ করা যাবে। প্রাপ্ত সকল মতামত ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। জাতীয় সংসদ কর্তৃক বাজেট অনুমোদনের সময়ে ও পরে তা কার্যকর করা হবে। বাজেট উপস্থাপনের পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার বেলা ৩টায়, ওসমানী মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

সূত্রঃ মানবজমিন 

Bootstrap Image Preview