Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

প্রেমে পড়া সেই দুই তরুণী ঘরছাড়া: সম্পর্কের মাঝে তিক্ততা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ এপ্রিল ২০২২, ০৭:১৯ PM
আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২২, ০৭:১৯ PM

bdmorning Image Preview


গাইবান্ধার এক তরুণীর সঙ্গে সিলেটের এক তরুণীর প্রেম গত ডিসেম্বরে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। প্রেমের টানে সিলেটের তরুণীটি চলে যান গাইবান্ধার তরুণীর বাড়িতে। পরিবারকে দিয়ে ফেলেন বিয়ের প্রস্তাব। এতে ‘আকাশ ভেঙে পড়ে’ পরিবারের বাকি সদস্যদের মাথায়।

অভিমানে এক তরুণী ছুরি দিয়ে হাত কেটে ও অপরজন গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেন। দুজনকেই গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সিলেটের তরুণীকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার পরিবার।

সেই দুই তরুণী কেমন আছেন, ঘটনার তিন মাস পর জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। জানা গেছে, দুই তরুণীই এখন ঘরছাড়া। এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের চাপের কারণে দুজনেই আছেন দুর্বিষহ জীবনে। দুই তরুণীর যোগাযোগ এখন শিথিল, প্রেমের সম্পর্কের জায়গায় জন্ম নিয়েছে তিক্ততা। দুজনের মধ্যেই তৈরি হয়েছে নানান অভিযোগ।

দুই পরিবার গত ডিসেম্বরে জানায়, দুই মাস আগে খেলার সুবাদে ঢাকায় দেখা হয় এ দুই তরুণীর। তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কিছুদিন পর সিলেটের তরুণী ফুটবল খেলতে যান গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। সে সময় সদর এলাকায় অপর তরুণীর বাড়িতে ওঠেন তিনি। এভাবে পরস্পরের প্রতি ভালো লাগা তীব্র হতে থাকে। তারা নিয়মিত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতেন।

এরপর হঠাৎ গাইবান্ধার তরুণীটি মোবাইল ফোনে কথা বলা বন্ধ করে দিলে অস্থির হয়ে সিলেটের তরুণীটি পরিবারের কাউকে না জানিয়ে চলে যান গাইবান্ধায়। পরিবারকে জানান বিয়ের সিদ্ধান্ত। পরিবার বাধা দিলে দুই তরুণী চেষ্টা চালান আত্মহত্যার।

গাইবান্ধা থেকে ফেরার পর নিজের ঘরে আর উঠতে পারেননি সিলেটের তরুণী। এখন নগরের অদূরে ভাড়া বাসায় একা থাকছেন, আছেন অর্থকষ্ট আর মানসিক যন্ত্রণায়।

সিলেটের তরুণী বলেন, ‘আমাদের দুজনের কিছু ভিডিও কেউ ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। এতে দুই পরিবারেই অশান্তি তৈরি হয়। থানা-পুলিশও হয়।

‘আম্মু চলে আসার পর ওই মেয়েকে তার পরিবারের লোকজন অন্যত্র বেড়াতে নিয়ে যায়। এরপর আমি সিলেট চলে আসি। মাস দেড়েক ধরে আমি সিলেটেই আছি।’

সিলেট নগরে মা আর ভাইদের সঙ্গে থাকতেন ওই তরুণী। তবে গাইবান্ধার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সিলেটে তাকে বাসায় তুলতে রাজি হননি ভাইয়েরা।

ওই তরুণী বলেন, ‘সিলেটে আসার পর ভাইয়েরা আমাকে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বাসায় উঠতে দেননি। আমার কারণে বড় বোনের বিয়েও একবার ভেঙে যায়। কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু আমি সেখানে যেতে পারিনি। পরিবারের সবচেয়ে আদরের মেয়ে ছিলাম আমি, অথচ এখন কেউ দেখতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘এখন আমি একটি ভাড়া বাসায় থাকি। একটি সুপারশপে কাজ করতাম। তবে ওই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সুপারশপের চাকরিও চলে গেছে।’

সিলেট জেলা নারী ফুটবল টিমে খেলতেন দাবি করে ওই তরুণী বলেন, ‘আমি শেখ রাসেল একাডিমেতে খেলতাম। কিন্তু গাইবান্ধার ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর আমারে আর খেলায় নেননি কোচ। ফলে এখন আর খেলি না।’

ওই তরুণীর মা বলেন, ‘এটা বড় শরমের কথা। বেটিনতে বেটিনতে (নারীতে নারীতে) একটা ভেজাল হইছিল। তার ভিডিও ছেড়ে দিছে। আমরা খুব শরমের মাঝে আছি।

‘ওর ভাইয়েরা তাকে ঘরে তুলতে চায় না। তাই আলাদা বাসায় থাকে। তবে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে কিছু টাকাপয়সা দেই। মায়ের মন তো, মেয়ের জন্য কাঁদে।

‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার ভাতা পাই আমি। সেই টাকা থেকে কিছু ওকে দিই। পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে গেলে তারে ঘরে নিয়ে আসব।’

গাইবান্ধার তরুণীও পরিবারের মাঝে ফিরতে পারেননি। এমনকি ঘটনার পর থেকে প্রতিবেশী ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোকজন তার পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ওই তরুণীর রিকশাভ্যানচালক বাবা থাকেন অন্যের জমিতে, ঝুপড়ি ঘরে। লোকলজ্জার পাশাপাশি তিনি উচ্ছেদ আতঙ্কেও ভুগছেন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ওই তরুণী হাসপাতাল থেকে বাড়িতে গেলে প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে তাকে বিতাড়িত করেন। পরে তিনি আশ্রয় নেন গোবিন্দগঞ্জের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এরপর থেকে মেয়েটির পড়ালেখাসহ ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে যায়।

তরুণীর বাবা বলেন, ‘পাড়াবাসী আমাক বেটির এটি থাকা (আমার মেয়ের এখানে থাকা) নিষিদ্ধ করি দিছি। জনগণের চাপোতে (চাপ) বেটিটাক শালির বাড়িত থুয়ে আসছি। আমার এক ছটাক জমিও নাই। আমি তো এখন নিরুপায় হয়া গেছি।’

তরুণীর মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লোকজন ছোলটেক (ওই তরুণী) এটি থাকপের দিল না। এখন হামাকও থাকপের দিতিছে না।’

প্রতিবেশী নবেজ আলী বলেন, ‘এগলের পর তো ওর পড়া বন্ধ। ফুটবল খেলা বন্ধ হয়া গেছে। বাড়িতও তাক মানষে থাকপের দিল না।’

বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া তরুণী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লোকজন আমাকে বলছে, তুই এখানে থাকতে পারবি না। তুই এখানে থাকলে তোর বাবা-মাকে মারধর করব। পরে বাধ্য হয়ে মানুষের চাপ আর লোকলজ্জায় বাড়ি থেকে চলে আসছি।’

গাইবান্ধা এএফসি নারী ফুটবল দলের সদস্য দাবি করা এই তরুণী বলেন, ‘এই ঘটনার পর আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। ফুটবলও খেলি না।’

কারা বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কয়জনের কথা বলব। আমার প্রতিবেশী, এমনকি রক্তের মানুষও আমাকে থাকতে দেয়নি। আমি নাকি খারাপ। মেয়ে এনে ব্যবসা করি। পরিবারের কথা ভেবে কষ্টে বাড়ি ছেড়েছি।’

বিচ্ছেদের পর দুই তরুণীর মধ্যে তৈরি হয়েছে তিক্ততা। গাইবান্ধার তরুণীর পরিবারের অভিযোগ, সিলেটের তরুণী নারী পাচারকারী দলের সদস্য। গাইবান্ধার তরুণীকে পাচারের উদ্দেশ্যে প্রেমের ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিলেটের তরুণী। তার দাবি, গাইবান্ধার তরুণীই তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন।

গাইবান্ধার তরুণীর বাবা বলেন, ‘খেলাটু (খেলোয়াড়) মহিলাটা (সিলেটের তরুণী) এক দিনের জন্যে হামার বাড়িত প্রশ্রয় (আশ্রয়) নিছে। এরপর এক সপ্তাহ থাকল। বান্ধবী সাজি কী কী রটাল। বাড়ি থাকি বাহিরও করি দিবের পাই নে।

‘পরে চেয়ারম্যানকে বিচার দিছি। তারা আসি মহিলাটাক গাড়িত তুলি দিল। আবার হুট করি চলতি গাড়িত থাকি ঝাঁপ মারি ফির আমার বাড়িত আসিল। কয়, হামার মেয়েকে বিয়ে করবো। পরে পুলিশ ডাকছি। পুলিশের সামনেও বিয়ে করবার চায়। মহিলা হয়া, বেটিক মহিলার কাছে কীভাবে বিয়ে দেই!’

গাইবান্ধার তরুণীর মা বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে ওই মেয়েটা বাড়িতে আসছিল। কয়দিন এটি (এখানে) ছিল। এরপর এই দুর্ঘটনা ঘটাছে। বল খেলার কথা কয়া আমার মেয়েক নিয়ে যাবার ধরছিল। আমি যাবার দিই নেই। এখন শুনতেছি ওই মেয়েটা নাকি মানব পাচারকারী। ফির (আবার) নাকি ঘটনা ঘটাছে সিলেটত একটা।’

বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া গাইবান্ধার তরুণীও জানিয়েছেন ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘শুনতেছি ও (সিলেটের তরুণী) নাকি পাচারকারী। কয়দিন আগে ওর একটা পিক (ছবি) ফেসবুকে দেখছিলাম, আরেক মেয়ের সঙ্গে ধরা পড়ছে। লোকজন ওকে মারধর করছে।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিলেটের তরুণী। তিনি বলেন, ‘আমি ওই জায়গা থেকে (গাইবান্ধা) আসার পর অনেক দিন হসপিটালে ছিলাম। এরপর এক দিন মাত্র ওর সঙ্গে কথা হইছিল। ও তো আমার ফিউচার-লাইফ সব নষ্ট করে দিছে।’

দুজনের পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় ছিলাম। ঢাকা থেকে গোবিন্দগঞ্জ খেলতে গিয়ে এক বান্ধবীর মাধ্যমে গাইবান্ধার ওই মেয়ের সঙ্গে পরিচয়। কিছুদিন আলাপের পর আমাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। এরপর আমি ওই মেয়ের বাসায় গিয়ে উঠি।’

তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি সিলেট চলে আসতে চাই। তখন ওই মেয়ে বলে আমি চলে আসলে সে হাত কাটবে। এরপর আমি তাদের বাসায় থেকে যাই।’

নারী পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি আগে ওকে (গাইবান্ধার তরুণী) প্রস্তাব দেইনি। ওই আগে আমাকে প্রস্তাব দেয়। আর আমি কেন পাচারকারী হব! আমি ওর ফাঁদে পড়ে প্রেমে পড়েছিলাম মাত্র।’

Bootstrap Image Preview