Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

চিনিকলগুলোতে ইচ্ছা করেই লোকসান!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৮:১১ AM
আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৮:১১ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


দেশের ১৫টি সরকারি চিনিকলের একটি বাদে সবই বর্তমানে চলছে লোকসানে। এসব চিনিকলের দেনার পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ চিনিকলগুলোর কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোকসানের জন্য সরকারের নীতি ও ব্যবস্থাপনা অনেকটাই দায়ী। একটু যতœ ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা হলেই চিনিকলগুলো হয়ে উঠতে পারে দেশের রপ্তানি আয়ের বড় একটি উৎস। সরকারি চিনিকলগুলোতে এই মুহূর্তে পৌনে ছয় হাজার লোকবল ঘাটতি রয়েছে। সেকেলে প্রযুক্তি বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও বেশি চিনি হয় এমন প্রজাতির আখ লাগানোর ব্যাপারেও নেই কোনো উদ্যোগ। এমনকি চিনিকলগুলোতে আখের উপজাত বা বাইপ্রোডাক্ট থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা দামি পানীয় তৈরি করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সে ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

সরকারি চিনিকলগুলোর কর্মী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি খাতে চিনি আমদানি এবং কারখানা মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বছরের পর বছর সরকারি চিনিকলগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেশি করে রেখেছে। যাতে সরকারি কারখানাগুলোর চিনি সাধারণ মানুষ ব্যবহার না করে বেসরকারি কারখানায় উৎপাদিত কম দামের চিনি ব্যবহার করে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) বর্তমানে ১৫টি চিনিকল রয়েছে, যার মধ্যে ৯টি চালু রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ। এসব চিনিকলের ব্যাংক ও শ্রমিকের দেনা রয়েছে ৮ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ রয়েছে ৩ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

বিএসএফআইসির তথ্য বলছে, অগ্রণী, সোনালী ও জনতা ব্যাংক থেকে সরকারি চিনিকলগুলো ২ হাজার ৩০২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণের ৮৮০ কোটি টাকা শোধ দেওয়ার পরও এখনো ৩ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে চিনিকলগুলোর কাছে। সরকার গত চার বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের অর্থ অবলোপন করলেও চিনিকলগুলোর ঋণ অবলোপন তো করেইনি, এমনকি সুদও মওকুফ করেনি। এসব চিনিকলে পড়ে আছে ৫৯ হাজার টনের বেশি চিনি ও প্রায় ৬০ হাজার টন চিটাগুড়।

যে কারণে লোকসানে : সরকারের বেঁধে দেওয়া প্রতি কেজি ৬০ টাকা দরে চিনি বিক্রি করছে বিএসএফআইসি। অথচ প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ১০০ টাকার ওপরে। ফলে সরকারি কারখানাগুলোতে প্রতি কেজি চিনিতে লোকসান হচ্ছে ৪০ টাকার ওপরে। কম দামে চিনি বিক্রি করে বিএসএফআইসি যে অর্থ লোকসান দিয়েছে তা সম্প্রতি সরকারের কাছে চেয়েছে। এই অর্থ পেলে চিনিকলগুলো ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী। সে সময় শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ‘র’ সুগার (অপরিশোধিত) থেকে ৩০ লাখ টন চিনি উৎপাদনের অনুমতি দেয়। শর্ত ছিল এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনের অন্তত অর্ধেক বা ২৫ লাখ টন চিনি বিদেশে রপ্তানি করবে, কিন্তু বাস্তবে তারা তা করেনি। এসব প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকার সময় বিপুল পরিমান ‘র’ সুগার কিনে মজুদ করে রাখে। তারপর তাদের সময়মতো বাজারে ছাড়ে। এ প্রতিযোগিতায় দেশের সরকারি চিনিকলগুলো পেরে ওঠেনি।

অন্যদিকে ভারত, নেপাল ও ব্রাজিলে আখচাষিদের ভর্তুকি দেওয়া হয়। ব্রাজিলে বছরে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রাজিলে চিনি উৎপাদনে সিস্টেম লস বা প্রথাগত লোকসানের পরিমাণ সর্বোচ্চ দেড় শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে সিস্টেম লস তিন শতাংশ। আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা গেলে এ সিস্টেম লস অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪৬ টন আখ হয়। অথচ অন্যান্য দেশে এর পরিমাণ ৭০ টন। এছাড়া বাংলাদেশে কম পরিমাণ চিনি হয় এরকম আখের আবাদই বেশি। ঈশ্বরদী-৩৫, ঈশ্বরদী-২২ ও ঈশ্বরদী-৩৬ জাতের আখে চিনি উৎপাদন বেশি হলেও বাংলাদেশের কৃষকদের এ জাতের আখ চাষে কোনোরকম উৎসাহ দেওয়া হয় না। আবার আখক্ষেত থেকে কেটে আনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাড়াই করতে পারলে তাতে চিনির পরিমাণ বেশি হয়। কিন্তু সরকারি অধিকাংশ কারখানায় দিনের পর দিন আখ গুদামে ফেলে রাখা হয়, ফলে চিনির পরিমাণও কমে যায়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেশের ১৫টি চিনিকলের শ্রমিক ও কর্মচারীদের আবাসস্থল পুরাতন ও টিনশেডের জরাজীর্ণ বাসাবাড়ি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া চিনিকলগুলোর চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্থা বেশ জরাজীর্ণ এবং অধিকাংশ কারখানায় চিকিৎসক, সিভিল প্রকৌশলী ও ইলেকট্রিক প্রকৌশলী নেই বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি ১৫টি কারখানায় শ্রমিক ও কর্মচারীর পদ খালি রয়েছে ৫ হাজার ৮১০টি। এসব শূন্যপদে নিয়োগ ও শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ করা গেলে কারখানার উৎপাদন বাড়বে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএসএফআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত সরকার আখচাষিদের স্বার্থে চিনি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে ভারত সরকার ‘র’ সুগার আমদানির ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। এতে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালে তিন বছরে দেশটির চিনিকলগুলো আবগারি শুল্ক বাবদ সরকারের কোষাগারে ৬ হাজার ৬০০ কোটি রুপি জমা দেয়। ওই অর্থ আবার চিনিকলগুলোকে বিনা সুদে পাঁচ বছরের জন্য ঋণ হিসেবে দেওয়ার জন্য চিনি রপ্তানির ওপর প্রতি টনে ৩ হাজার ৩০০ রুপি নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাদের কেন্দ্রীয় সরকার। যার ফলে ভারতে চিনির দাম ও চিনি রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।

পথ দেখিয়েছে কেরু : চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় ১৯৩৮ সালে কেরু অ্যান্ড কোং নামে একটি চিনিকল নির্মাণ করা হয়। সব চিনিকল যখন লোকসানে তখন কেরু ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫৯৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। কেরুর এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে বড় কারণ প্রতিষ্ঠানটির নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন। গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ১১৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে।

কেরু কারখানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি চিনির পাশাপাশি নতুন পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে। এসব পণ্যের মধ্য রয়েছে করোনাকালে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার। কেরুর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি জৈব সার উৎপাদনও করছে। বছরে কেরু প্রায় দুই হাজার টন জৈব সার উৎপাদন করে থাকে।

কেরু মাড়াইকৃত আখের উপজাত থেকে অ্যালকোহল (মদ) উৎপাদন করে। তাদের দুটি ডিস্টিলারি প্ল্যান্টে উৎপাদন বাড়িয়েছে। কোম্পানিটি তাদের নিজস্ব ওয়্যারহাউজ ও বিক্রয়কেন্দ্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী মদ বিক্রি করে। প্রতি মাসে ২০ হাজার কেসের বেশি মদ উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানিটি দেশের দুই পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় দুটি নতুন বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করছে। গত অর্থবছরে কেরু শুধু মদ বিক্রি করেই ১৯০ কোটি টাকা আয় করেছে।

কেরু কান্ট্রি স্পিরিট (সিএস), রেকটিফায়েড স্পিরিট (আরএস) ও ডিনেচারড স্পিরিট (ডিএস) এবং মল্টেড ভিনেগার ও হোয়াইট ভিনেগার নামে দুই ধরনের ভিনেগার উৎপাদন করে। কেরুর বছরে উৎপাদন ক্ষমতা ১ দশমিক ৩৫ কোটি প্রুফ লিটার। কেরুর বিদেশি ব্র্যান্ডের মদগুলো হলো ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, শেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, সারিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য চিনিকলকে কেরুর মতো ঢেলে সাজাতে হবে। চিনির উপজাত হিসেবে সারা দুনিয়াতে মদ উৎপাদন হয়ে থাকে। দেশে এর বড় বাজার রয়েছে। কেরুর মদের মানও ভালো। কেরুর মতো অন্যান্য চিনিকলে চিনির উপজাত দিয়ে উন্নতমানের মদ উৎপাদন করা গেলে বাড়তি আয় আসবে বলেও তাদের মত।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে চিনিকলগুলোকে ঢেলে সাজানোর একটি রোডম্যাপ দিয়েছি। আগামী পাঁচ বছর যদি সরকার আমাদের সাপোর্ট দেয় তাহলে চিনিকলগুলো ঘুরে দাঁড়াবে, প্রত্যেকটি চিনিকল লাভে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে আমাদের বছরে ৩০০ কোটি টাকার মতো সাপোর্ট লাগবে। এরপর এটি কমে ১০০ কোটিতে নেমে আসবে। এ সাপোর্ট পাঁচ বছর লাগবে। পাশাপাশি আমাদের যে ব্যাংক ঋণ রয়েছে তা মওকুফ করার জন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি। এসব হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চিনিশিল্পে নতুন কিছু পাওয়া যাবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান কমদামে “র” চিনি আমদানি করে স্টক (মজুদ) করে পরে বিক্রি করছে, তাদের সঙ্গেও আমরা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাব যদি আমরা সাপোর্ট পাই। আর সরকার যদি চিনিশিল্প রক্ষায় “র” চিনি আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করে তাহলে তো কথাই নেই। সেটি আরও ভালো হবে।’ সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকলে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘চিনিকলগুলোকে লাভজনক করা গেলে সেটা দেশের জন্য খুবই ভালো সংবাদ। তবে এসব কারখানায় নানান ধরনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এসব সবার আগে মুক্ত করা দরকার।’

Bootstrap Image Preview