Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

পথে-ঘাটে ওঁৎ পেতে থাকে পেশাদার অপরাধী চক্র; বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২২, ০৩:৪৭ PM
আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২২, ০৩:৪৭ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পেশাদার অপধারী চক্রের সদস্যরা। পথে-ঘাটে ওঁৎ পেতে থাকে চোর, ছিনতাইকারী। তারা সুযোগ বুঝে টার্গেটের ওপর হামলে পড়ছে। লুটে নিচ্ছে পথচারীর সর্বস্ব। সশস্ত্র ছিনতাইকীদের হামলায় অনেক সময় বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। বেড়েছে ভয়ঙ্কর খুনের ঘটনাও।

চাঁদাবাজি, দস্যুতা, গাড়ি ও মোটরসাইকেল চুরির ঘটনার পারদও ঊর্ধ্বমুখী। প্রকাশ্যে দিনদুপুরেও এ ধরনের অপরাধ হচ্ছে। আর রাতের রাজধানী এখন অনেকটাই অরক্ষিত। অন্ধকার নামলে মানুষের চলাচল মোটেও নিরাপদ নয়। এতে ঘর থেকে বেরুলেই ঢাকাবাসীর মধ্যে ভর করে অজানা আতঙ্ক। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ পরিসংখ্যানও বলছে, সম্প্রতি বেড়েছে প্রায় সব ধরনের অপরাধ। ডিএমপির ৫০ থানায় গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে যেসব অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

অপরাধ কর্মকাণ্ড সামাল দিয়ে মানুষের মনে স্বস্তি ফেরাতে থানা পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের অপরাধ সভায় ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম এই নির্দেশনা দেন। থানাভিত্তিক অপরাধীদের তালিকা হালনাগাদ করে তাদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশও দেন তিনি।

ডিএমপির মাসিক অপরাধ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে নয়টি খুনের ঘটনা ঘটে। ফেব্রুয়ারিতে খুনের ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ তে। এর মধ্যে পাঁচটি খুনই হয়েছে মিরপুর এলাকায়। মার্চ মাসের খুনের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড আলোচিত হয়েছে দেশ জুড়ে। ২৪ মার্চ শাজাহানপুরে ব্যস্ততম রাস্তায় প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী ঘাতক। এতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। একই ঘটনায় ঘাতকের তপ্ত বুলেটে প্রাণ হারান রিকশারোহী পথচারী কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি। গুলিতে আহত হন টিপুর মাইক্রোবাস চালক মনির। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই স্বাধীনতা দিবসের ভোরে মিরপুরের কাজীপাড়ায় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসাবে খ্যাত উদ্যমী দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। কিন্তু দুটি ঘটনার একটিরও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। আস্থাহীনতার কারণে নিহত কলেজছাত্রী প্রীতির পরিবার থানায় অভিযোগও দায়ের করেননি। বিচার চাননা প্রীতির বাবা। এছাড়াও টিপু মার্ডারের একদিন পর ২৫ মার্চ সবুজবাগের বাসায় ঢুকে গৃহবধূ তানিয়া আক্তারকে নির্দয়ভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

অপরাধ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের মতে, দীর্ঘদিন করোনা মহামারির কারণে রাস্তাঘাটে মানুষের সমাগম কম ছিল। তখন অপরাধ প্রবণতাও ছিল কম। এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। রাজধানীর কর্মব্যস্ত মানুষ ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় চলাচল করছে। এই সুযোগে খুন-খারাবি, চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে। কর্মহীন ছিন্নমূল কিছু মানুষও চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধকে বেছে নিচ্ছে জীবিকার তাগিদে। আবার মাদকাসক্তরা নেশাদ্রব্য কেনার টাকার জন্য চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমানের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ছিনতাই, চুরি, দস্যুতাসহ অন্তত ৫ ধরনের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ-করোনা মহামারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। এ সময়ে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। পণ্যের মূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নানারকম চাপে সমাজের একশ্রেণির মানুষ নতুন করে অপরাধে জড়াচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা হতাশা থেকে অপরাধ করছে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে গেলে আইনশৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাড়ে অপরাধের ঘটনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে শিথিলতার কারণেও চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের মাত্রা বাড়ে। ভোরে ও রাতে পুলিশের টহল কম থাকার সুযোগ নিয়েও চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া খুন বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে অনেক নতুন নতুন মুখ খুন, চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়াচ্ছে।

ডিএমপির তথ্য বলছে, খুনের ঘটনার সঙ্গে মোটরসাইকেল ও গাড়ি চুরির ঘটনাও বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে ডিএমপির থানাগুলোতে মোটরসাইকেল ও গাড়ি চুরির ৩১টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে এমন মামলা হয়েছে ৩৬টি। জানুয়ারিতে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে সাতটি। ফেব্রুয়ারিতে একই অপরাধে মামলার সংখ্যা নয়। তবে থানার মামলা পরিসংখ্যানের সঙ্গে সংঘটিত অপরাধের মাত্রায় মিল নেই। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেশির ভাগ চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশি ঝামেলা এড়াতে মামলা করতে থানায় যায় না ভুক্তভোগীরা। আবার বেশির ভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে চুরির মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি করতে ভুক্তভোগীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পুলিশ। ফলে মূল অপরাধের ঘটনা পরিসংখ্যানের বাইরে থেকে যায়। আবার সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে চাঁদাবাজির ঘটনায় অনেকেই মামলা দূরের কথা পুলিশের নজরেই আনে না। তারা নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে গোপনে চাঁদা দিয়ে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপস করেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীতে বেপরোয়া ‘উড়ন্ত ছিনতাইকারী’ গ্রুপের সদস্যরা। তারা বেশিরভাগ সময় প্রতিটি থানার সীমান্ত পয়েন্টগুলোকে বেছে নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে টার্গেটে হামলে পড়ে। ছিনতাইয়ের পর খুব সহজেই তারা এক থানা থেকে আরেক থানা এলাকায় ঢুকে যায়। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করতে গেলে ভোগান্তির শিকার হয়ে মামলা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ পুলিশ দায় এড়াতে ভিকটিমকে এক থানা থেকে আরেক থানায় পাঠায়। থানায় থানায় ঘোরার পর অনেক সময় ছিনতাইয়ের মামলা না নিয়ে আইনি ঝক্কি-ঝামলার কথা বলে চুরি কিংবা ‘হারিয়ে গেছে’ মর্মে সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেন। এতে ক্ষোভে অনেকেই থানা থেকে ফিরে আসেন। রাজধানীতে জানুয়ারি মাসে মাত্র পাঁচটি এবং ফেব্রুয়ারি মাসেও সমান সংখ্যক ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। ডিএমপির এই পরিসংখ্যানের বিষয়টিই এসব বাস্তবতা স্পষ্ট করে তোলে। কারণ নগরজীবনে ছিনতাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যমে ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি ব্যস্ততম মৌচাকের অফিস থেকে মেরুল বাড্ডার বাসায় ফিরছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী খন্দকার পলাশ। রাত ৮টার দিকে তাকে বহনকারী রিকশা রামপুরা বাজার এলাকায় পৌঁছায়। এ সময় তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ ছোঁ মেরে পলাশের মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারী। পুলিশি ঝামেলা ও ফোন উদ্ধার না হওয়ার শঙ্কায় তিনি থানায় অভিযোগ করেননি। গত সপ্তাহে সন্ধ্যার পর আগারগাঁও আইডিবি ভবনের অদূরে মোটরসাইকেল আরোহী এক নারীর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকরী। কিছু টাকা ও মোবাইল ফোনসহ লুট হওয়ার পরও অক্ষত অবস্থায় জীবন রক্ষা পাওয়াতেই খুশি তিনি। ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে তিনিও থানায় অভিযোগ করেননি। এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় নিত্যদিনই পাওয়া যায়।

পুলিশের মতে, খুনের ঘটনা বেড়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে। এছাড়া বিভিন্ন কারণে নগরজীবনের চাপ সামলাতে মানুষের হিমশিম অবস্থা। এতে মানুষ তুচ্ছ কারণেও অসহিষ্ণু হয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে।

এদিকে, রাজধানীতে ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত অপরাধ পর্যালোচনা করতে ডিএমপির মসিক সভা গত ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে করণীয় ঠিক করতে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে ডিএমপি কমিশনার মাঠ কর্মকর্তাদের কঠোর বার্তা দেন। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থানার অফিসার ইনচার্জদের ব্যর্থতার জন্য শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন। একইসঙ্গে প্রতিটি থানায় অপরাধীদের তালিকা হালনাগাদ করে তাদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন। টহল টিমের তৎপরতা বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। থানাগুলোতে টহল জোরদার ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধীদের শনাক্ত করতে নতুন কৌশলে কাজ চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, থানায় সেবা নিতে গিয়ে ফিরে আসার পুরোনো ধ্যান-ধারণা ঠিক নয়। যে কোনো অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীরা থানায় গেলে তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সূত্র: যুগান্তর/ মাহবুব আলম লাবলু 

Bootstrap Image Preview