Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

তাঁরা বন্ধু নন, পেশাদার ক্রিকেটার!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২২, ০৬:৪০ AM
আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২২, ০৬:৪০ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


সাইদুজ্জামান, ডারবান থেকে । বৃহস্পতিবার রাতে চার সতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে টিম হোটেলের পাশের নিউজ ক্যাফেতে কফি খাচ্ছিলেন তামিম ইকবাল। চারদিক গমগম করছে স্থানীয় এবং পর্যটকদের আড্ডার হুল্লোড়ে। এর মধ্যেই সদ্যই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ী দলের অধিনায়কের ক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল পাশের টেবিলে, ‘হোয়াই মি? আমাকেই কেন বারবার এই প্রশ্ন করা হবে?’ তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ যে পারলে যে প্রতিষ্ঠানের মঞ্চে বসে এমন প্রশ্নটা শুনতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে দূতিয়ালির চুক্তিই বাতিল করে দেন!

আসলেই তো, তামিমের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কোনো দিন কোথাও কেউ সাকিব আল হাসানকে এমন প্রশ্ন করেছেন বলে শোনা যায়নি। কেন? অবশ্য সাকিব এই প্রশ্নের কী উত্তর দিতে পারেন, সেটি অনুমান করা যায়।

একবার বাংলাদেশের এক ডাকাবুকো কোচের সঙ্গে সাকিবের ব্যক্তিগত সম্পর্কের পতন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি স্মিতহাস্যে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘উনি আমার কোচ, বন্ধু হবেন কেন?’ তা ছাড়া একটা দলের, সমাজের সবাই সবার বন্ধু কি? ভারতের বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মার মাঝে বিরাগের অদৃশ্য দেয়াল আছে। তবে সেই দেয়াল দুজনেই তুলে দেন মাঠের পেশাদারিত্বে। কোহলিকে এখনো বিরাটই মনে করেন রোহিত। আর নিজের অধিনায়কত্বকালে অবিরাম ওপেনার রোহিতকে সমর্থন করে গেছেন কোহলি। মাঠে এই দুজনকে দেখলে কে বলবে, ভেতরে বরফ জমে আছে? এমন উদাহরণ বিশ্বের প্রায় সব দেশের সব দলে, সমাজেই আছে।

বাংলাদেশের এই দুই তারকার একেবারে শুরু থেকে শুরু করা যাক। সাকিবের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের তারকা জগতে তামিমের প্রবেশ। ২০০৭ বিশ্বকাপে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে তামিমের বাউন্ডারি ভারত জয়ের স্মারক হয়ে আছে। সেদিন ফিফটি করেছিলেন সাকিব ও মুশফিকুর রহিমও। কিন্তু ম্যাচস্মৃতিতে তামিমই সবচেয়ে উজ্জ্বল। ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা মাশরাফি বিন মর্তুজাও ‘সাহসী’ তামিমকে ঘিরে চলমান আলোচনায় পিছিয়ে পড়েন। অবশ্য আকরাম খানের ভাইয়ের ছেলে, যাকে-তাকে তুলে তুলে মারে—ঢাকায় ক্রিকেট খেলার আগেই দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে পরিচিত নাম তামিম ইকবাল খান।

এরপর খুব বেশিদিন যায়নি। লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাকিবের খুব বেশি সময় লাগেও না। ব্যাটে-বলে ধারাবাহিক নৈপুণ্যে দ্রুতই উজ্জ্বলতম তারকা হয়ে ওঠেন তিনি। খ্যাতির জগতে ‘অভিষেক’ বিবেচনা করলে অর্ডারটা হওয়ার কথা তামিম ও সাকিব। কিন্তু রেসে এগিয়ে গিয়ে সেটা উল্টে হয় সাকিব-তামিম। ‘দুই বন্ধু’কে নিয়ে অন্তহীন চর্চা হতে থাকে গণমাধ্যমে।

মাঠে, মাঠের বাইরে দুজনে দুজনের ছায়া হয়ে থাকেন। জাতীয় দলে তাঁরা বিশেষ দুজন। ভিক্টোরিয়ার জার্সিতেও তাঁরা আলাদা, ম্যাচের দিন দুজনে করপোরেট বক্সে বসে লাঞ্চ করেন ক্লাব মালিকের সঙ্গে। টাইমলাইন বলছে, তাঁদের বন্ধুত্বের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ার শুরু তখন থেকেই। এক্স-রেতে ধরা পড়ে, সেই কঙ্কালের গায়ে খ্যাতি আর এন্ডোর্সমেন্ট মার্কেটে উদ্দাম রেসে ধরা চিড়! দুজনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্রিগেড আবার সেই চিড় খুঁচিয়ে চুরমার করে দিয়েছে। দুই গ্রুপের আক্রমণের পাল্টাপাল্টি দেখে বিশ্বাস হয় না যে সাকিব ও তামিম একই দেশের জার্সিতে খেলেন! 

যাক, তাঁরা আর বন্ধু নন—এটা নিয়ে লুকোছাপা করার কিছু নেই। অপ্রকাশিত তথ্য হলো—সাকিব ও তামিম কখনো হরিহর আত্মা ছিলেনও না। এই দুজনকে দীর্ঘকাল খুব কাছ থেকে দেখা একজনের মন্তব্য, ‘সাকিবকে বন্ধু মনে করত তামিম। সাকিব সেরকম কিছু মনে করত বলে আমার মনে হয়নি। সাকিব তো একটু অন্য রকম। একসঙ্গে খেলে, বিদেশ ঘোরে...এটুকুই। ওর মনোজগতের সঙ্গে তামিমেরটা মেলানো ঠিক হবে না। সবাই তো আর এক রকম হয় না। ’

তামিম বরাবরই আবেগপ্রবণ। জীবনে চলার পথে যাঁরাই সামনে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে একটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করেছেন। স্বার্থ মিশে গেছে হৃদ্যতায়। আর সাকিবের আবেগ যদি কিছু থাকে, সেসব আছে তাঁর মনে কিংবা ক্রিকেট কফিনে। নিজ পরিবারের বাইরে সাকিবের ‘বন্ধু’ বলতে করপোরেট জগতের কেউকেটা কেউ, যেখানে দুই পক্ষই স্বার্থের সূক্ষ্ম জালে জড়িয়ে। ক্রিকেট সাকিবের পেশা। একজন পেশাদারের স্বার্থচিন্তা তো থাকতেই পারে। মোটকথা একজনের পেশাদারিত্বে আবেগের মাখামাখি আছে, অন্যজনের পেশাদারিত্ব শতভাগ আবেগের মেদহীন। তাই তামিমের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্য, সাকিবেরটা জানা হয় না কারো।

দুজনার দুটি পথও অনেক দিন ধরেই বিপরীতমুখী। টিম বাস কিংবা বিদেশ ট্যুরে একই ফ্লাইট ছাড়া সাকিব-তামিম সর্বশেষ ভ্রমণসঙ্গী হয়েছিলেন প্রায় তিন বছর আগে। ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় এয়ার টার্বুলেন্সের ভয়ে ইংল্যান্ডের এক শহর থেকে আরেক শহরে ড্রাইভ করে গিয়েছিলেন তাঁরা। অবশ্য সঙ্গে এই দুই মেগাস্টারের মাঝে ‘মেলবন্ধন’ হয়ে সফরসঙ্গী ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।

এক দশক আগের মতো ড্রেসিংরুমে সাকিব-তামিম জম্পেশ আড্ডা দেন না। আগের মতো লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, মোবাইল কিংবা কোন রেস্টুরেন্ট ভালো—এ জাতীয় আলাপ হয় না তাঁদের। তবে ম্যাচ পরিকল্পনায় কেউ কাউকে বাগড়া দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। বরং তামিমের দৃষ্টিতে সাকিব সব সময়ই বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার। ওপেনার তামিমের সামর্থ্য নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেননি সাকিবও। আর মাঠে তাঁরা বাংলাদেশের প্রতিনিধি। একজন এক ফরম্যাটের অধিনায়ক বটে, তবে প্রয়োজনের সময় অন্যজন্য পরামর্শ দেন।

কাকতালীয়ভাবে সেঞ্চুরিয়নে সিরিজ জয়ের স্ট্রোকটা খেলেছেন সাকিব। আর বাতাসে ঘুষি মেরে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তামিম। এরপর দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছেন, যে ছবিটা তাঁদের ‘কথিত’ বন্ধুত্বের শুরু থেকেই সবচেয়ে আকর্ষক।

২০২২ সালের ২৩ মার্চের ফ্রেম যতটা আকর্ষক, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তাৎপর্যটা হলো, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুতা কেটে গেলেও বাংলাদেশের জার্সিতে তাঁরা আগের মতোই দুর্ধর্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত সাফল্য-ব্যর্থতার মতো দলের জয়-পরাজয়ও স্পর্শ করে তাঁদের।

দেশের ক্রিকেটের মঙ্গলের জন্য এই দুজনের কাছ থেকে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে।

বৃহস্পতিবার রাতে চার সতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে টিম হোটেলের পাশের নিউজ ক্যাফেতে কফি খাচ্ছিলেন তামিম ইকবাল। চারদিক গমগম করছে স্থানীয় এবং পর্যটকদের আড্ডার হুল্লোড়ে। এর মধ্যেই সদ্যই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ী দলের অধিনায়কের ক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল পাশের টেবিলে, ‘হোয়াই মি? আমাকেই কেন বারবার এই প্রশ্ন করা হবে?’ তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ যে পারলে যে প্রতিষ্ঠানের মঞ্চে বসে এমন প্রশ্নটা শুনতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে দূতিয়ালির চুক্তিই বাতিল করে দেন!

আসলেই তো, তামিমের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কোনো দিন কোথাও কেউ সাকিব আল হাসানকে এমন প্রশ্ন করেছেন বলে শোনা যায়নি। কেন? অবশ্য সাকিব এই প্রশ্নের কী উত্তর দিতে পারেন, সেটি অনুমান করা যায়।

Bootstrap Image Preview