Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মনে আছে সেই ‘ইয়াবা-সুন্দরী নিকিতার কথা? যার অন্তর্বাসের বিলাসিতায়ও ছিলো চমক

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ১২:০৭ PM
আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ১২:০৭ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


‘ইয়াবা সুন্দরী নিকিতা’ নামটি বেশ আলোচিত ছিল একসময়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশেষ অভিযানে অন্ধকার জগৎ থেকে প্রকাশ্যে মুখ দেখাতে বাধ্য হয়েছিলেন কথিত ‘মডেল’ নিকিতা। তার স্খলনের মূলে ছিল মাদক। তাই তো নায়িকা-সদৃশ সুন্দরী নিকিতার কপালে সেদিন জুটেছিল ‘ইয়াবা-সুন্দরী’র তকমা।

নিকিতার পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস নিকিতা। তবে একযুগের বেশি সময় চলে গেলেও আজ পর্যন্ত অনেকেই তাকে ‘ইয়াবা-নিকিতা’ নামেই মনে রেখেছেন। মাকদের কারবারে জড়ানোর পর নিকিতার জীবনে বেড়ে যায় বিলাসিতা। চেহারা আরও আকর্ষণীয় বানাতে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা খরচ করেন তিনি, যার পরিচর্যায় মাসে ব্যয় হতো অর্ধলাখ টাকার বেশি। এছাড়া বিদেশি বড় ব্যান্ডের দামি পোশাক ও অন্তর্বাসও পরতেন তিনি।

কোথায় আছেন সেই নিকিতা? এখনও কী ইয়াবা সাম্রাজ্যে তার পদচারণা আছে? এমন প্রশ্ন আছে অনেকের মনেই। তবে নিকিতার ঘনিষ্টরা জানিয়েছেন, তিনি একসময় দেশের বাইরে থাকতেন। এখন দেশেই আছেন। মাঝে মধ্যে বিদেশে যান। তবে কোন দেশে থাকতেন বা যান তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

যেভাবে অপরাধ জগতে নিকিতা:

উগান্ডার নাগরিক আমিন হুদার হাত ধরে ২০০৪ সালে ‘ইয়াবা যুগে’ প্রবেশ করে বাংলাদেশ। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মাদকসেবীদের কাছে নতুন স্বাদের এক নেশা হিসেবে তা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমিন হুদা নিজেই গুলশানের ১২৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে ইয়াবার কারখানা গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, সুন্দরী রমণীদের দিয়ে রাজধানী কেন্দ্রিক ইয়াবা বিক্রির একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি।

২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) একটি টিম জান্নাতুল ফেরদৌস নিকিতা এবং তার সহযোগী হোটেল পূর্বাণীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান জয়নালসহ আরও কয়েকজনকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক করে। সেসময় আটক করা হয় নিকিতার বাবা আবদুন নূর, মা সালেহা বেগম, ভাই মইনুদ্দিনকে। জব্দ করা হয় নিকিতার একটি গোপন ডায়রিসহ আরও কিছু আলামত। তাদেরকে পুলিশে হস্তান্তরের পর আদালতে হাজির করা হয়।

পরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন (সিএমএম) ম্যাজিস্ট্রেট প্রাথমিকভাবে নিকিতাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং জয়নালকে ৩ দিনের রিমান্ডে পাঠান। ১০ নভেম্বর শুধু নিকিতা নন, তার বাবা-মা ও ভাইকেও একযোগে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। বেশ কিছু দিন অন্ধকার কারা-প্রকোষ্ঠে দিন-রাত কাটিয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে নিকিতা বাইরের আলোতে ফিরে আসেন।

জেল তাকে ছাড়লেও নিকিতা ইয়াবাকে ছাড়তে পেরেছিলেন কি-না, কিংবা ইয়াবা তাকে ছাড়তে পেরেছিল কি-না, সেই তথ্যও থেকে গিয়েছিল অজানা। তবে একটি সূত্র জানায়, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নিকিতা ও তার বোন পুষ্পিতা ইয়াবা কারবারিতে পুনরায় জড়িয়ে যান।

আমিন হুদা জেলে থাকাকালে তাদের সিণ্ডিকেট দেখভাল নিকিতাই করতেন। এসময় তার (নিকিতা) দুবাই, সিঙ্গাপুর ও জাপানে বেশ যাতায়াত ছিল। মাদকবিরোধী অভিযানে অনেক কারবারি আত্মগোপনে এবং বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এতে অনেকটা সতর্ক হয়ে যায় নিকিতা সিণ্ডিকেট।

নিকিতার বিলাসিতা:

সবসময় আলোচিত ছিলেন ইয়াবা সুন্দরী নিকিতা। শুধু মাদকই নয়, বিয়ের নামে প্রতারণাও তার অন্যতম পেশা ছিল। তাছাড়া নিকিতা বিদেশ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ করে তার ত্বক পরিবর্তন করেন। ত্বকের পরিচর্যায় মাসে তার খরচ হতো ৬০ হাজার টাকা। দুজন গৃহকর্মী নিয়মিত পরিচর্যা হিসেবে তার শরীরে লোশন লাগিয়ে দিতেন। তাছাড়া ত্বকের সমস্যায় গ্লাবস পরে খাবার খেতেন নিকিতা।

বিদেশি যে অন্তর্বাস পরতেন নিকিতা:

নিকিতা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের ভিক্টোরিয়া সিক্রেট কোম্পানির অন্তবার্স পরতেন। এ কোম্পানিটি নারীদের জন্য দামি অন্তবার্স তৈরি করে। দেশে অধুনা আবির্ভুত ইয়াবা আসলে মেথামফিটামিন-এর একটি যৌগিক মিশ্রণ। ১৮৮৭ সালে জার্মানিতে তৈরি অ্যামফিটামিন এবং ১৯১৯ সালে জাপানে তৈরি মেথামফিটামিন-এর উন্নততর ও আধুনিক সংস্করণ হলো এই ইয়াবা। অ্যামফিটামিন-এর অ্যানালগ মেথামফিটামিন-এর সঙ্গে আরও কতিপয় যৌগের মিশ্রণে ইয়াবা তৈরি হয়। তখন এই ইয়াবার ব্যাপক চাহিদা ছিল। পাশাপাশি ছিল উচ্চমূল্য।

বিএনপির সাবেক এমপিকে বিয়ে:

নিকিতাকে গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তৎকালীন র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক সুলতান মোহাম্মদ নূরানি। তখন তিনি নিকিতা সম্পর্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান গণমাধ্যমে। মোহাম্মদ নূরানি বলেন, ২৬ বছর (২০০৭ সালে তার বয়স ছিল) বয়সী নিকিতার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায়। তিনি মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সোহরাব ১৯৯৬ সালে ও ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হন। রাজধানীর বনানীতে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট (ফ্ল্যাট) নিকিতাকে উপহার দিয়েছিলেন সোহরাব উদ্দিন। কিন্তু ২০০৬ সালের জুলাই মাসে দুজনের ডিভোর্স হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেমিক ও তার আত্মহত্যা চেষ্টা:

বিএনপির সাবেক এমপি সোহরাবকে বিয়ের আগে দক্ষিণ কোরিয়ার এক বাংলাদেশির সঙ্গে নিকিতার সম্পর্ক ছিল। সোহরাবের সঙ্গে ডিভোর্সের পরে নিকিতার সঙ্গে সেই ব্যক্তির এনগেজড হয়। নিকিতা তাকে দেশে ফিরে আসতে প্ররোচিত করেন। সোহরাবের সঙ্গে বিয়ের আগে ওই ব্যক্তি কোরিয়া থেকে প্রতিমাসে একলাখ টাকা নিকিতার খরচের জন্য পাঠাতেন।

প্রভাবশালী ধণাঢ্য এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক:

নিকিতা গ্রেপ্তারের পর তখন র‌্যাব জানায়, কোরিয়া প্রবাসী সঙ্গে অ্যানগেজড হওয়ার পরেও ২০০৭ সালের মার্চে মাহবুবুর রহমান জয়নাল (হোটেল পূর্বাণীর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক) নামে বিত্তশালীর সঙ্গে নিকিতার পরিচয় হয়। এরই মধ্যে সাবেক প্রেমিকা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দেশে চলে আসেন। কিন্তু নিকিতা তাকে প্রত্যাখান করেন। তারপর ওই ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এমনকি ৫৭ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর সেই প্রবাসী সম্পূর্ণ সুস্থ হন।

জিদে চাটার্ড বিমান ভাড়া করে কক্সবাজার ভ্রমণ:

নিকিতার বোন পুষ্পিতার এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়। তারা আত্মীয়দের নিয়ে একটি জিএমজি এয়ারলাইনের চার্টাড ফ্লাইটে কক্সবাজারে ঘুরতে যায়। কিন্তু নিকিতা তাদের সঙ্গে কক্সবাজার যেতে আপত্তি জানান। উল্টো নিকিতা জয়নালকে আরেকটি জিএমজি এয়ারলাইন চার্টাড ফ্লাইটে কক্সবাজার যেতে বাধ্য করেন। সেখানে হোটেল সিগ্যাল-এর সবচেয়ে দামী স্যুটে উঠেন নিকিতা। যার ভাড়া ছিল প্রতি রাতের জন্য ২৭ হাজার টাকা (২০০৭ সালে)।

নিকিতার কসমেটিক সার্জারির ব্যয় বহন ও জাপান ভ্রমণ:

নিকিতা গ্রেপ্তারে পর র‌্যাব জানায়, ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে কসমেটিক সার্জারি করেন নিকিতা। অপারেশনের সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করেন ব্যবসায়ী জয়নাল। এছাড়া, অপারেশনের পরে তার সৌন্দর্য স্বাভাবিক রাখতে প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা খরচ করতেন। নিকিতা ও জয়নাল বিনোদনের জন্য ১১ দিনের জন্য জাপানেও গিয়েছিল। সেখানে দু’জনে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করেন। বিত্তবান হওয়া স্বত্ত্বেও জয়নাল হোটেলের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বেতন দিতেন না বলেও অভিযোগ ছিল।

কারাগারেই শেষ হয় আমিন হুদা অধ্যায়:

দেশের ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত সাজাপ্রাপ্ত আসামি আমিন হুদা মারা যান ২০২০ সালের ৬ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

২০০৭ সালে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মাদক আইনে দুইটি মামলা হয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই দুই মামলায় বিভিন্ন ধারায় আমিন ও তার সহযোগীকে মোট ৭৯ বছর করে কারাদণ্ড ও জরিমানার আদেশ দেয় আদালত।

পরে আমিন হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ মে জামিন বাতিল করে আপিল বিভাগ। তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশও দেওয়া হয়। তখন থেকেই কারাগারে ছিলেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যা বলছে: আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর একাধিক সূত্র  জানিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমবার গ্রেপ্তার হন নিকিতা। মডেলিং পেশার আড়ালে তিনি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অভিযানে নিকিতার একাধিক ঘনিষ্ঠ সহযোগী গ্রেপ্তার হয়।

এরপর থেকেই তিনি প্রকাশ্যে থেকে আত্মগোপনে যান। মাঝে মধ্যেই তিনি দেশের বাইরে যেতেন। তবে তার সিণ্ডিকেট এখন অনেকটা নিষক্রিয়। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেয়। সূত্র জানায়, আমিন হুদা মারা যাবার পর পুনরায় আলোচনায় আসে নিকিতা। তবে সেসময় তার সন্ধান করেও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ধারণা করা হয়, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বিদেশেই সম্পদ করেছেন নিকিতা। একারণে গ্রেপ্তারের পরপরই বিদেশে আত্মগোপনে যান তিনি। আর বেশির ভাগ সময়ই তাকে দেশের বাইরেই যাবার খবর পাওয়া যেত।

Bootstrap Image Preview