Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৩ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

হাবীবের ডেডস্পটের পাশে বেলচা হাতে ওরা তিনজন কারা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারী ২০২২, ০১:২০ PM
আপডেট: ২৪ জানুয়ারী ২০২২, ০১:২০ PM

bdmorning Image Preview


গত মঙ্গলবার। রাত তখন ২টা ৩৭ মিনিট। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে এক ব্যক্তি পুলিশকে জানান, হাতিরঝিলের সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল এলাকায় একজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পড়ে থাকা মানুষটি ছিলেন সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হাবীব রহমান। যে স্থানে তার রক্তাক্ত দেহ পড়েছিল, সেখান থেকে সাড়ে ৩ মিনিট হাঁটলেই রানারের মোড় (বেগুনবাড়ী এলাকা থেকে হাতিরঝিলে ওঠার নতুন সংযোগ সড়ক)। সেখানকার একটি সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়- রাত ২টা ৩১ মিনিটে ঘটনাস্থলের দিক থেকে তিন ব্যক্তি বেলচা হাতে সন্দেহজনক গতিবিধি নিয়ে অনেকটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন। আড়চোখে তাকাচ্ছেন চারদিকে। এ ঘটনা ৯৯৯-এ কল করার ৬ মিনিট আগের।

এত রাতে বেলচা হাতে ওই তিনজনের হেঁটে যাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরাপত্তাকর্মীরা।

তাদের হেঁটে যাওয়ার মধ্যে ছিল আতঙ্ক। এদিক-ওদিক চাওয়া-চাওয়ি করছিলেন। মাথায় তোলা ছিল হুডি। হাতে বেলচা থাকলেও তাদের পোশাক দেখে কেউ শ্রমিক বলবেন না। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে- বেলচা হাতে ওই তিনজন কারা?

সিসি ক্যামেরার সাদা-কালো একটি ফুটেজে দেখা যায়, ১৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাত ২টা ২৪ মিনিট ৩২ সেকেন্ডে একটি মোটরসাইকেল হাতিরঝিলের প্রবেশমুখ হয়ে গুলশান নিকেতনমুখী সড়কে উঠছে। ধারণা করা হচ্ছে ওই মোটরসাইকেলটি সাংবাদিক হাবীব রহমানের। আশপাশের আরও কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ঘেঁটে দেখা যায়, হাতিরঝিলের প্রবেশমুখ হয়ে নিকেতনের দিকে রাত ১টা ৩৩ মিনিট থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত ১৩টি মোটরসাইকেল প্রবেশ করে। ওই পথে রাত ২টা ২৯ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডে একটি পুলিশের গাড়ি ঢোকে। ২টা ৩০ মিনিটে সেখানে হাতিরঝিল রেড ফোর্সের একজন কর্মীকে দেখা যায়। হাতিরঝিল ফ্লাইওভারের নিচের (মধুবাগ যাওয়ার পথ) একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, হাবীব রহমান যেখানে পড়ে ছিলেন, সেদিক থেকে রাত ২টা ৩১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি বেলচা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ২টা ৩২ মিনিট ১২ সেকেন্ডে আরও দুই যুবককে দেখা যায় বেলচা হাতে নিয়ে যেতে। অনেকটা দ্রুত পায়ে এগোচ্ছেন তারা। তাদের হেঁটে যাওয়ার ভাষায় ছিল আতঙ্ক। চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন বারবার।

এ ছাড়া সিসি ক্যামেরায় রাত ২টা ২৮ মিনিটে হাতিরঝিলে প্রবেশ করতে দেখা যায় র‌্যাবের একটি টহল টিমকে। রাত ২টা ৫৮ মিনিটে ওই টহল টিম রানারের মোড় হয়ে মধুবাগের দিকে যায়। আশপাশের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার দিনের বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী শাহীন হোসেন পাটোয়ারী। শনিবার তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় ঘটনাস্থলের সামনে। শাহীন বলেন, আমি সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল এলাকায় থাকি। পেশায় পিকআপ চালক। রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে পোড়াবাড়ির দিকে এক পীরের খানকার উদ্দেশ্যে ওই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সামনে কড়ইগাছের নিচে ফুটপাথে একজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। ওই যুবকের মাথায় তখনও হেলমেড ছিল। তিনি বলেন, তার শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন চোখে পড়েনি। শুধু মুখের অংশটুকু ছিল থেঁতলে যাওয়া। ফুটপাথের ওপরে চিৎ হয়ে পড়ে ছিল দেহটি। এ সময় একটি মোটরসাইকেল দাঁড়ান ছিল, আরেকটি কাত হয়ে পড়ে ছিল। শাহীনের ভাষ্য, সেখানে তিনি দুজন লোককে দেখতে পান। এরপর আরও লোকজন জড়ো হতে থাকে। এ সময় একজন ৯৯৯-এ কল করেন। পরে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তিনি চলে যান। শাহীন সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হলে চালকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা। কিন্তু তার মুখ ছাড়া আর কোথাও তেমন আঘাতের চিহ্ন দেখিনি। তার ভাষ্য- এই ঘটনা রহস্যজনক।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করা ব্যক্তির নাম রাসেল। প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল রোববার জানান, ঘটনার রাতে তখন সিদ্দিক মাস্টারের ঢালে ছিলেন তিনি। বলেন, রাত আনুমানিক প্রায় আড়াইটার দিকে বিকট শব্দ পাই। এরপর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পাই এক যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তখন আমি ৯৯৯-এ কল করি। তখন আনুমানিক রাত ২টা ৩৭ মিনিট হবে। তখনও ওই যুবক জীবিত ছিল। তবে কথা বলতে পারেনি। এরপর পথচারীরা এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাদের কারও নাম জানা নেই বলে জানান রাসেল।

সরেজমিনে দেখা যায়, সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল থেকে হাবীব রহমানের ডেডস্পটের দূরত্ব পায়ে হেঁটে ১৬৫ কদম। সময় লাগে ১ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের মতো। সেখান থেকে রানারের সংযুক্ত সড়কের মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লাগে ৩ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। এর ৩৬২ কদম পশ্চিমে, যেখানে সিসি ক্যামেরা রয়েছে, সেদিক থেকে দেখা যায়- সন্দেহজনক গতিবিধি নিয়ে বেলচা হাতে একজন একজন করে পার হচ্ছেন তিন ব্যক্তি। তারা কারা, এ বিষয়ে আশপাশের কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে এত রাতে বেলচা নিয়ে কী কারণে তাদের এই যাত্রা, সন্দেহমূলক সেই প্রশ্ন স্থানীয়দেরও।

সিদ্দিক মাস্টারের ঢালে অবস্থিত হাতিরঝিল আহসানুল মসজিদ উলুম মাদ্রাসা ও এতিম খানা। ওই মসজিদের কোষাধ্যক্ষ রুবেল জানান, মসজিদের পরের ভবনটি তার নিজের। ঘটনার দিন তিনি সংবাদ পেয়ে সেখানে যান। রুবেল বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় একজনকে পড়ে থাকতে দেখি। কিন্তু তার মুখ ছাড়া অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন চোখে পড়েনি। ‘বিষয়টি রহস্যজনক’ মন্তব্য করে রুবেল বলেন, ঘটনাস্থলের সামনে যে সিসি ক্যামেরা রয়েছে, সেটি দীর্ঘদিন অকার্যকর বলে জানতে পেরেছি। ঠিক এই জায়গাতেই এমন দুর্ঘটনা, এটি ‘রহস্যজনক’।

গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাবীব রহমানের ডেডস্পটে এখনও পড়ে আছে হেলমেটের ভাঙা টুকরো টুকরো অংশ। তবে রক্তের কোনো দাগ সেখানে দেখা যায়নি। এই কয়েকদিনে ধুলোয় মুছে গেছে। যেখানে হাবীব রহমান পড়ে ছিল, সেখান থেকে অন্তত ২০ কদম আগে থেকেই ফুটপাথের নিচের অংশে কোনো কিছু টেনেহেঁচড়ে নিয়ে আসার দাগ চোখে পড়ে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই মাসুদ খলিফা গতকাল বলেন, আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে দুর্ঘটনার বিষয়ে তথ্য নিয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করছি। নিহতের স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। তিনি ঢাকায় ফেরার পর তদন্তের স্বার্থে কথা বলব। ঘটনার দিন কোথায় ছিলেন হাবীব রহমান, কার সঙ্গে কতক্ষণ সময় কাটিয়েছেন- এসব বিষয়ে পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পরিবারের সদস্যরা একে নিছক দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করছেন- এ ব্যাপারে এসআই মাসুদ বলেন, আমরা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এখনও হাতে পাইনি। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর মূলত এই ঘটনার সঠিক কারণ জানা যাবে।

ঘটনার পরপরই হাবীব রহমানের পরিবারের সদস্যরা বলেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। ঘটনা উদঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি দাবি জানান তারা। প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে হাতিরঝিলের সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল এলাকায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার ও আওয়ামী লীগ বিটের সাংবাদিক হাবীব রহমানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করা হাবীব একসময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন। দৈনিক সময়ের আলোর হয়ে সদ্যসমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন করেছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার মনরা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়।

সূত্রঃ সময়ের আলো/ এসএম মিন্টু ও সাইফুল ইসলাম

Bootstrap Image Preview