Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

সাগরে ১৮ দিন ভেসে থাকার রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন জেলেরা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারী ২০২২, ০৩:০৫ PM
আপডেট: ১৯ জানুয়ারী ২০২২, ০৩:০৫ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


‘মাত্র ৪ বছর বয়সী ছেলে রেখে সাগরে গিয়েছিলাম। ছেলেটা আমার সারাদিন বাবা বাবা বলতেই থাকে। সাগরে চলে আসার শেষ মুহূর্তে কী কান্না! জড়িয়ে ধরে আর ছাড়তেই চায় না। অনেক কষ্টে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসব কথা দিয়ে সাগরে যাই। ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে সাগরে যখন ভাসছিলাম বারবার ছেলেটার কথা মনে পড়ছিল। বেঁচে ফেরার আশা যখন শেষ তখন কাঁদতাম আর আল্লাহর কাছে চাইতাম একবারের জন্য হলেও ছেলেকে দেখার সুযোগ করে দাও। একবার একটু বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই। আল্লাহ আমার শেষইচ্ছা পূরণ করেছেন।’

এভাবেই মুঠোফোনে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা জেলে সালাহ উদ্দীন। ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে ১৮ দিন ধরে আরও ১৯ জেলেসহ বঙ্গোপসাগরে ভেসেছেন তিনি।

নিশ্চিত মৃত্যু হবে ভেবে হাতের আংটি, তাবিজ ও ঘড়ি সাগরে ফেলে দিয়েছিলেন তারা। কেঁদেছেন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে, মাফ চেয়ে নিয়েছেন ভুল-ভ্রান্তির জন্য। টানা ১৮ দিন সাগরে ভাসার পরে ভারতের উড়িষ্যা পৌঁছান জেলেরা। ১৩ দিন নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখার পরে জেলেদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয় ভারতীয় কোস্টগার্ড। সেখান থেকে আরও ৪ দিন পরে বাড়ি পৌঁছান জেলেরা।

উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন- নুরুল ইসলাম, তাছিন, নুরুল ইসলাম, হানিফ, সোহেল, বেল্লাল, আলাউদ্দিন আহমেদ, আবু বকর, মিরাজ, সালাহউদ্দিন, সালাউদ্দিন, সবুজ, হারুন, জামাল, বসর, মোস্তাফিজ, সোলাইমান, আবু জাহের, রিপন ও দেলোয়ার।

‘৪৫ বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সাগরে যাই। অনেক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মুখে পড়েছি। তবে এত বড় বিপদে কখনো পড়িনি। ইঞ্জিনের ট্রলার হওয়ায় কোনো পাল ছিল না আমাদের। শীত নিবারণের জন্য নেওয়া কম্বল দিয়ে পাল টানাই। সঙ্গে বইঠা দিয়ে বাইতে থাকি। এভাবে ৫ দিন চলার পরেও কোনো কূলকিনারা পাই না। কোনো মাছ ধরা ট্রলার বা জাহাজের দেখাও নেই। অন্যদিকে ১০ দিন হয়েছে বাড়ি থেকে আসছি। চাল, পানিসহ অন্য খাবারও শেষের পথে। কী করব, কীভাবে বাঁচব? এতগুলো মানুষ।’ বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী মাঝি মো. আবু বকর।

এই মাঝি বলেন, ‘৭ ডিসেম্বর ভোরে ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়াঘাট থেকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে ট্রলার ছাড়ি আমরা। সাথে দশ দিনের রসদ। ২৪ ঘণ্টা একটানা দক্ষিণের দিকে চালিয়ে মাছ ধরা শুরু করি আমরা। দুই ধাপ মাছ ধরার পরে ৯ ডিসেম্বর দুপুর ৩টার দিকে আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট হয়, ঠিক করার জন্য নোঙর ফেলি। রাতে সাগর কিছুটা উত্তাল হয়ে ওঠে, বাড়তে থাকে বাতাসের চাপ। ঢেউ থেকে বাঁচতে সাগরের মধ্যে জাল ফেলি।’

কিন্তু পরবর্তী দিনেও ইঞ্জিন ঠিক না হওয়ায় স্রোতের অনুকূলে তীরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। ঢেউয়ে বাধ্য হয়ে সাগরে ফেলা জাল কেটে দেই। এরপরেই শুরু হয় অথৈ পানির মধ্যে দিকশূন্যে ভয়াল দিন-রাত্রি। দুই হাজার বাম (এক বাম সমান চার হাত) রশি ফেলেও সাগরের তল পাই না। নোঙর করতে না পেরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি সবাই। বেঁচে ফিরতে পারব কি না, পরিবার পরিজনের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। এই ভেবে কান্না জুড়ে দেয় কয়েকজন। বেঁচে ফেরাটা এখনো স্বপ্ন মনে হয়  বলে জানান এই মাঝি।

হারুন নামের এক জেলে জানান, ১০ দিন খাওয়ার মতো রসদ ছিল আমাদের কাছে। ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার ৭-৮ দিন পরেই সবজি, অন্যান্য খাবার ও পানি শেষ হয়ে যায়। তখন বরফ গলা পানি দিয়ে দিনে মাত্র ২ কেজি চাল রান্না শুরু করলাম। সকালে ফ্যান (ভাতের মাড়) আর রাতে লবণ-ভাত ভাগ করে খেতাম। গভীর সাগরে ট্রলার ভাসছে, আর মৃত্যুর চিন্তাও বাড়ছে। সবাই মিলে আল্লাহকে ডাকি, যদি কেউ আমাদের উদ্ধার করেন।’

সবুজ নামের অপর এক জেলে বলেন, ‘২৪ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফুটেছে। এর মধ্যে ১৬ দিন কেটে গেছে সাগরে। সেদিন সত্যিই মনে হচ্ছিল আর বাঁচব না। এর আগে তবু আশায় বুক বেঁধে ছিলাম যে, কেউ না কেউ উদ্ধার করবে আমাদের। কিন্তু ১৭ দিনেও কারো দেখা না পাওয়ায় আমরা বুঝে যাই আমাদের মৃত্যু এভাবেই লেখা রয়েছে। তাই সবাই-সবার কাছে ক্ষমা চাই। আল্লাহর নাম ডাকি। হাতে থাকা আংটি, তাবিজ ও মাজার তাগি (কালো রঙের মোটা সুতা) ফেলে দেই সাগরে। ছোটবেলায় শুনেছি মরার পরে এসব রাখতে হয় না। মারা গেলে কী বলে সাগরে ফেলে দেওয়া হবে এই চিন্তাও করেছিলাম আমরা।’

৩৭ বছর ধরে সাগরে যাওয়া ট্রলারের অপর এক মাঝি নুর ইসলাম জানান, ‘২৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে প্রবল গতির একটি স্রোত আসে। ট্রলারেও অনেক পানি উঠে যায়। স্রোতের সাথে ভাসতে থাকি আমরা। জানি না কোন দিকে যাচ্ছি। কয়েক ঘণ্টা পরে ট্রলারের পাটাতনের তক্তা খুলে কয়েকজন মিলে স্রোতের অনুকূলে বৈঠা বাওয়া শুরু করি। এভাবে ২০-২২ ঘণ্টা পর স্রোতটি থেমে যায়, রশি ফেলে দেখি ৭৮ বাম পানি। আবারও পাঁচটি বৈঠা দিয়ে একই দিকে বাইতে শুরু করি।’

তিনি আরও বলেন, ২৬ ডিসেম্বর রশি দিয়ে দেখি ১৭ বাম পানি। ক্ষুধার্ত শরীর ও মৃত্যুভয়ে ক্লান্ত মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও শরীরে এক বিন্দু শক্তি ছিল না। সেখানে নোঙর ফেলে সবাই ট্রলারের পাটাতনে শুয়ে পড়ি। কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ দূরে একটি ভারতীয় ট্রলার দেখে চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু তারা কী কারণে জানি না সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি। তাদের ভাষাও বুঝি না। দূর থেকে ইশারা করে বুঝিয়ে দেয় যে পূর্ব দিকে গেলে সাগরের কিনারা পাওয়া যাবে।’

‘শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে সবাই মিলে বৈঠা বেয়ে তাদের নির্দেশিত পথে যেতে থাকি। অনেকটা পথ যাওয়ার পরে অপর একটি ভারতীয় ট্রলারের দেখা পাই। তখন আমাদের দয়া দেখিয়ে, ভারতীয় ওই মাছধরা বোট আমাদের টেনে কূলে পৌঁছে দেয়। জানতে পারি ভারতের উড়িষ্যা এলাকার পারাদ্বীপ বন্দর এটা। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার আনন্দে সবাই-সবাইকে ধরে কান্নাকাটি করছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমরা কূলে পৌঁছাতে পেরেছি।’  

তিনি আরও জানান, এরপরে দেখা হয় ভারতীয় কোস্টগার্ডের সঙ্গে। তারা আমাদের খাবার ও পানি দেয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা বসে আমাদেরসহ ট্রলারের প্রতিটি ইঞ্চি তল্লাশি করে তারা। পরে সন্দেহ দূর হলে আমাদের আপ্যায়ন করেছে। থাকতে দিয়েছে, খাবার দিয়েছে। কোস্টগার্ডের স্যারেরা আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন ঠিক করার চেষ্টাও করেছে কিন্তু পারেনি। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

১৩ দিন ভারতীয় কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে থাকার পরে বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের হাতে জেলেদের তুলে দেয় তারা। ১০ জানুয়ারি দুপুরে ট্রলার মালিক আবুল কাশেম ও জেলেদের পরিবারের সদস্যদের কাছে তাদের হস্তান্তর করে মোংলা কোস্টগার্ড। এরপরে তিন দিন ট্রলার চালিয়ে ১৩ জানুয়ারি বাড়ি পৌঁছায় জেলেরা।

ট্রলার মালিক আলী কাশেম বলেন, একদিকে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ট্রলার, অন্যদিকে ২০ জেলে। দুঃশ্চিন্তায় নিজেরই মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। এরমধ্যে জেলেদের পরিবারের কান্না। সব মিলিয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছিলাম। অবশেষে ৩০ ডিসেম্বর সবাই বেঁচে আছেন জানতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি আমরা। সবার পরিবারকে জানাই। আল্লাহর রহমতে জেলেরা সুস্থ শরীরে ফিরতে পেরেছে।

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন মোংলার জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম মোসায়েদ হোসেন বলেন, ১০ জানুয়ারি কোস্টগার্ডের জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারতীয় কোস্টগার্ডের জাহাজ সরোজিনি নাইডু থেকে ট্রলারসহ ২০ জেলেকে গ্রহণ করে। একই দিন দুপুরেই জেলেদের তাদের মহাজন ও ট্রলার মালিক আবুল কাশেমের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তবে সালাহ উদ্দিন নামের এক জেলে আর সাগরে ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। আবার সাগরে যাওয়ার কথা বললে বৃদ্ধা মা, ছোট ছেলে হাত জড়িয়ে ধরে যেতে না করেছে। ছেলেটা বলতেছে, ‘তোমার সাগরের কামাই আমরা আর খাবো না।’ মা বলতেছে, ‘বাজান কম খাই, না খেয়ে থাকি তবু সাগরে যাইস না।’ তাই পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে সাগরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সালাহ উদ্দিনের মা কুলসুম বেগম বলেন, ছেলে আমার কোলে ফিরে এসেছে তাতেই আমি খুশি। ওই দিনগুলোতে পুত্রবধূ, নাতিদের গলা জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদতাম। আল্লাহর রহমত করেছে, তাই আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি। ও (সালাহ উদ্দিন) আবার সাগরে যেতে চায়, আমাদের এদিকে তেমন কাজের সুযোগ নেই। কিন্তু আমি নিষেধ করেছি। না খেয়ে থাকলেও ছেলেকে আর সাগরে যেতে দিব না।

চরফ্যাশন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার বলেন, ভারতের উড়িষ্যায় উদ্ধার ২০ জেলে নিরাপদে আছেন। আমরা কোস্টগার্ডের মাধ্যমে খবর পেয়ে ট্রলার মালিককে জানাই। পরবর্তীতে আইনি প্রক্রিয়া শেষে জেলেরা সবাই ফিরে আসলে প্রথমেই তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং কোভিড টেস্ট করানো হয়। কোভিড পরীক্ষার ফলাফল সবার নেগেটিভ এসেছে।

চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল নোমান জানান, সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেরা সবাই বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন। আমরা তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছি। জেলেরা সবাই এখন সুস্থ আছেন।

সূত্রঃ ঢাকা পোষ্ট/ তানজীম আহমেদ

Bootstrap Image Preview