ফেনীর রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরে ব্যাপকভাবে আলোচিত ফেনীর আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী চির প্রস্থানের পথে যাত্রা করেছেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে অনেকটা নিভৃতচারী হয়ে উঠলেও আলোচনা ও বিতর্ক তাকে পিছু ছাড়েনি। রাজনীতিতে নামিদামি থেকে শুরু করে জনসাধারণ পর্যায়ে বহু মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিলেও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সঙ্গিনীর বাহুডোঁরে বাঁধা পড়া হয়নি তার। বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিকদের ৫০ পেরোনো বয়সে বিয়ে ও ঘর-সংসার করতে দেখা গেলেও এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমৃত্যুই ছিলেন ‘চিরকুমার’।
কিন্তু কেন তার এই একলা যাপন? কেন চার হাত এক হয়নি তার? কেনইবা কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেননি? সদ্য মারা যাওয়া জয়নাল হাজারীর অবিবাহিত জীবন নিয়ে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে জনমানুষের মধ্যে কৌতূহলে কখনোই ভাটা পড়েনি। তিনি নিজেও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে একাধিকবারই ব্যক্তিগত জীবনের বাহাস শুনিয়েছেন। তবে চিরকুমার জয়নাল হাজারী কখনোই অবিবাহিত জীবনকে কোনো ‘গ্যাপ বা শূন্যতা’ হিসেবে স্বীকার করেননি।
জয়নাল হাজারী, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি একসময় ফেনীর গডফাদার নামেও পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য। রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুললেও ব্যক্তি জীবনে ‘চিরকুমার’ জয়নাল হাজারী।তাঁর চিরকুমার থাকার থাকার পেছনে ‘বিজু’ নামের এক তরুণীর সঙ্গে বিচ্ছেদের কাহিনী সবার মুখে মুখে। হাজারী তার নিজের লেখা বইতেও বিজুর কথা লিখেছেন। তাঁর লেখা ‘বিজুর বিচার চাই’ বইটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
বিজুর সঙ্গে বিচ্ছেদের সেই কাহিনী নিয়ে এতদিন পরে আবারও প্রশ্ন করা হয় জয়নাল হাজারীকে। প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হলেও, পরে গড়গড় করে বলে দিলেন বিজুর কাহিনী। বললেন, ‘আমি যখন ফেনী কলেজের ছাত্র ছিলাম, সেও তখন ফেনী কলেজের ছাত্রী ছিল। সে গান গাইতো। আমি গীতি নকশা করতাম। আমি স্টেজে কথা বলতাম। সে গান গাইতো। এভাবেই আমাদের ভালো সম্পর্ক ও প্রেম হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি যখন যুদ্ধে চলে গেলাম। তখন তার বাপসহ, তার বাবা দক্ষিণপন্থী ছিলেন। তারা সোনাদিয়া এলাকায় আত্মগোপন করে। সেখানে একটা রাজাকার অনেকটা জোর করেই তাকে বিয়ে করে ফেলে।
বিজুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল সে আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। কিন্তু বোঝা গেল সে খুব প্রেশারে পড়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের সময়েই খবর পাচ্ছিলাম যে বিজুর বিয়ে হয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আমি তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারতাম। যেহেতু আমার দল ছিল, ক্যাডার ছিল। তখন কোন প্রশাসনের ধার ধারতে হতো না। আমিই ফেনী পরিচালনা করি। তবে আমি সেটা করিনি। আমরা যে ওয়াদা করেছিলাম সেটা সে রাখেনি। পরবর্তীতে এর কোন প্রতিকারও সে করেনি। কেন সে ওয়াদা ভঙ্গ করলো সেটার জন্যই আমি বিজুর বিচার চেয়েছি।
বিজুর সঙ্গে পরবর্তীতে আমার আর কখনও কথা হয়নি। সে একটা স্কুলে মাস্টারি করতো। সেখান থেকে রিটায়ার্ড করেছে। রিটায়ার্ড অনুষ্ঠানে আমাকে অতিথি করার জন্য স্কুল থেকে ফোন দিয়েছে কিন্তু আমি যাইনি। আরএ জন্যই আমি ‘চিরকুমার’।
বিজুর বর্তমান অবস্থা নিয়ে বলেন, ‘বিজুর স্বামী মারা গেছে। ওর একটা ছেলে কানাডা থাকে। সবাই বলে জয়নাল হাজারীর ছেলে। যেহেতু বিজুর সঙ্গে বিয়ের আগে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা যে সে আমার ছেলে। কারণ এমন কিছু আমাদের ছিল না।’
জয়নাল হাজারীর সেই ভিডিও সাক্ষাৎকারটি দেখতে ক্লিক করুন...
১৯৪৫ সালের ২৪ আগস্ট ফেনী শহরের সহদেবপুর নিবাসী হাবিবুল্লাহ পণ্ডিতের বাড়িতে আব্দুল গণি হাজারী ও রিজিয়া বেগমের সংসারে জন্ম জয়নাল আবেদীন হাজারীর। হাবিবুল্লাহ পণ্ডিত ছিলেন তার নানা।
জয়নাল হাজারী ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় ফেনী সরকারি কলেজে তৎকালীন ছাত্র মজলিশের (বর্তমান ছাত্র সংসদ) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন। এরপর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদেও দায়িত্ব পালন করেন জয়নাল হাজারী।
একাত্তরের রণাঙ্গনের এ বীরসেনানী ১৯৮৪-২০০৪ পর্যন্ত ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফেনী-২ (ফেনী সদর) আসন থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। শেষবার এমপি হয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে ১৭ আগস্ট রাতে তার বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। তিনি তখন ভারতে চলে যান। ২০০৪ সালে জয়নাল হাজারীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তিনি ভারত থেকে দেশে ফেরেন এবং চলমান মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে একে একে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পান হাজারী। কিন্তু ফেনী জেলা আওয়ামী লীগে ফিরে পাননি নিজের হারানো অবস্থান। পরে তিনি ‘হাজারিকা প্রতিদিন’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনায় মনোযোগী হন।
রাজনৈতিক সতীর্থ ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিষয়ে নানা মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব থাকা জয়নাল হাজারী ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে পদ পান।