Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

কক্সবাজারে পর্যটক যেন এককজন আসামী

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।
প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০৫ PM
আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০৫ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


একে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য কম, তার উপর থাকা-খাওয়ার খরচ খুব বেশি। সিজনে ডাল-ভাতের দাম উঠে ৪০০ টাকা প্লেটে। দেশের পর্যটন রাজধানী বলে পরিচিত কক্সবাজারে মুকুটে এবার নতুন পালক যুক্ত হলো। সেখানে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। তিনি জানান, স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে হত্যার ভয় দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন তিন যুবক। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব।

কক্সবাজারে এখন লক্ষ লক্ষ ট্যুরিস্ট, আছে আমাদের সাধারণ পুলিশ, র্যাব এবং পর্যটনের জন্য সৃষ্ট ট্যুরিস্ট পুলিশও। এরপরও এমন ঘটনা ঘটতে পারে এই ‘পর্যটন নগরী’তে! ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর যাত্রা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশের। পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি হোটেল-মোটেলের নিরাপত্তা এবং জনগণকে সচেতন করতে নানা ধরনের কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে সংস্থাটি। কিন্তু আগে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তদন্ত করার ক্ষমতা ছিল না তাদের। ২০২০ সালের ৩ জুন পর্যটকদের ফৌজদারি অপরাধসহ ২২ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাদের। এরপরও এমন ঘটনায় তারাও নিশ্চয়ই বিব্রত।

ব্যাপক আলোচনা শুরু হওয়ায় নিশ্চয়ই এখন তৎপরতা চলবে আসামীদের ধরতে। আসামীদের পরিচয়ও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে এবং তাদের ফেসবুকের পোস্ট সমূহ বলছে তারা খুবই ধার্মিক। ঈমান-আকিদার কথাই বেশি বলা হয়েছে এসব পোস্টে। কিন্তু এলাকাবাসীর কাছে এরা চিহ্নিত সমাজ বিরোধী এবং এদের ছবি পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় সাংসদের সাথেও।

ঘুরতে যেতে কে না ভালবাসে। তবে ঘুরতে যাওয়ার জন্য অবশ্যই পছন্দসই জায়গা দরকার। দেশজুড়ে অনেক পর্যটন স্থান রয়েছে। কিন্তু মানুষের প্রথম পছন্দ কক্সবাজার। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতই এর আসল কারণ। কিন্তু এটি আসলে কোন পর্যটন নগরী নয়। এক কংক্রিটের ভাগাড়। শুধু হোটেল আর গেস্ট হাউজের পাহাড়। হ্যাঁ, দীর্ঘ সৈকত আছে, কিন্তু দখল আর দূষণে সেটাকে উপভোগ করা যায় না। সাগরের কোল ঘেঁষেও তৈরি করা হয়েছে প্রভাবশালী মহলের হোটেল।

সমস্যা অনেক। প্রথমেই কথা বলা যাক রাস্তাঘাটের বেহাল দশা নিয়ে। মানুষ তার মানসিক সুস্থতার জন্য যায় সেখানে। কিন্তু কক্সবাজার পথ স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। খানাখন্দে ভরপুর পর্যটন শহর হিসেবে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন উপসড়কের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। পর্যটন স্পটগুলোসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় নির্মিত ফাইভ স্টার মানের হোটেল-মোটেলগুলোর সামনে এমন কিছু রাস্তা রয়েছে যা দেখলে কখনও মনে হবে না এটি পর্যটন শহর। নামিদামি হোটেল-মোটেলের পাশে নালা-ডোবা, ময়লা-আবর্জনা ভর্তি পুকুর। বর্ষা এলে এসব রাস্তার চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। সাগরের মতোই ঢেউ খেলানো সব রাস্তা। শহরের সর্বত্র সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্তও যানজট লেগে থাকে। সড়ক পথে রাস্তায় চলে চাঁদাবাজি। এসব চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পর্যটকরা সবসময় বিব্রত অবস্থায় পড়েন।

বর্জ্য ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এই শহরে নেই এবং কেন কালে ছিল কিনা কেউ মনে করতে পারেন না। এত হোটেল, এত স্থাপনা। কোনো হোটেলে নেই বর্জ্য এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ফলে ময়লা-আবর্জনা রাস্তার ওপর পড়ছে। দায় আছে কক্সবাজার পৌরসভার এবং কেনভাবেই দায় এড়াতে পারবে না হোটেল মালিক কর্তৃপক্ষও।

অপরিকল্পিত ভবনের কথা না বলাই ভালো। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট যত্রতত্র বহুতল ভবন গড়ে উঠার কারণে পর্যটন শহরের প্রকৃতিক সৌন্দর্য বিলীন হয়ে গেছে। আছে শুধু ইটের স্থাপনা। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটা আছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা একটি শহরকে আর পরিকল্পনায় ফেরানো সম্ভব বলে মনে করছেন না স্থানীয়রা।

সবচেয়ে বড় সমস্যা এখানকার মানুষের মনস্তত্ব। এক একজন পর্যটক যেন এদের কাছে এককজন আসামী। ভরা মৌসুমে কয়েক লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে এ শহরে। লাখ লাখ পর্যটক আগমনের এ সুযোগে মানুষের সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করে রিকশা, টমটম ও সিএনজি অটোরিকশা চালকরা। তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে। সাথে আছে হয়রানি। বিদেশি হলেতো কথাই নেই। চুম্বকের মতো লেগে তাকে স্থানীয় টাউটরা। অনেক অসাধু চালক পর্যটকদের সর্বস্ব ছিনিয়েও নেন এমন অভিযোগও শোনা যায়। ফটো তোলার নামে হয়রানি, খাওয়ার দোকানে জোচ্চুরি সহ কি নেই এখানে? একটা ভরা মৌসুমে ডাল ভাতের দাম হয় প্লেট প্রতি ৪০০ টাকা! বিচে বসা যায় না হকারদের উৎপাতে।

মানুষ কেন এভাবে এভাবে উপচে পড়ে কক্সবাজারে সে নিয়ে গবেষণা গওয়া দরকার। এক তথাকথিত দীর্ঘ সৈকত, বিপুল পরিশান হোটেল-মোটেল, আর বেশি দামে অতি সাধারণ খাওয়া ছাড়া কিছু নেই সেখানে। ১২০ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ৩ কিলোমিটার। আর তা নিয়েই কত না মাতামাতি। সৈকতে লক্ষ লক্ষ মানুষ, নারীরা ঠিকমতো সাগরের পানিতে নামতেও পারে না লক্ষ চোখের সামে। একদম বিচের কোল ঘেঁষে মসজিদ হচ্ছে, হোটেলতো আছেই, আছে নানা প্রকার স্থাপনা যা দৃষ্টি দূষণের কারণ। আর আগেই বলেছি পর্যটক বিরোধী স্থানীয় মনসতত্ত্ব। দিনের বেলায় ঘুরাঘুরি, সন্ধ্যে হলে খেয়ে দেয়ে হোটেল বন্দি। সান্ধ্যকালীন কোন আয়োজন নেই, নেই একটা কালচারাল একাডেমিও যেখানে গেলে বাংলাদেশকে জানবে একজন পর্যটক, আমাদের ইতিহাস জানবে, কিংবা স্থানীয় সংস্কৃতিকে বুঝবে।

ধর্ষণ কাণ্ডের পর কী একটু সজাগ হবেন কর্তৃপক্ষ?

 সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, জিটিভি

Bootstrap Image Preview