ঋতু আক্তার (৩০)। পেশায় যৌনকর্মী। গত ৯ অক্টোবর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লি থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, এই নারীর হত্যার নেপথ্যে কোনও খদ্দের নয়, তারই ‘ভালোবাসার মানুষ’, ‘প্রেমিক’, ‘বাবু’ বা ‘কথিত স্বামী’। যৌনকর্মীরা তাদের প্রেমিককে ‘বাবু’ বলেই সম্বোধন করে। মূলত এসব ‘বাবু’দের মাধ্যমেই যৌনপল্লিতে আসে নারীরা। যৌনকর্মীদের আয়ের একটি বড় অংশও তারা নিয়ে নেয়। তারপরও যৌনকর্মীদের আয়ের টাকায় নিয়েই এসব খুনাখুনির ঘটনা ঘটে প্রায়ই।
যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠনের কর্মীরা জানিয়েছেন, যৌনকর্মীরা বেশিরভাগ সময় তার পরিচিত ব্যক্তি ও বাবুদের মাধ্যমেই খুন হয়। অপরিচিত খদ্দেররা কখনও পল্লিতে বা হোটেলে গিয়ে খুন করার সাহস পায় না। কারণ, ওই জায়গা যৌনকর্মীদের, সেখানে অপরিচিত কেউ গিয়ে খুন করতে পারে না। অতীতে অনেক ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, খুনের নেপথ্যে পরিচিত কোনও বাবু বা দীর্ঘদিনের প্রেমিক বা খদ্দের।
ঋতু আক্তার এক সন্তানের মা ছিলেন। ঘটনার পর পুলিশ তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে ঋতুর বাবু সুজন খন্দকারের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। ওই দিন রাতেও সুজন ঋতুর ঘরে এসেছিল। সকালে তার লাশ মেলে।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল্লাহ আল তায়াবীর জানান, হত্যাকাণ্ডের শিকারে ঋতুর কথিত স্বামী সুজন খন্দকারসহ দুজনকে ঘটনার পর আটক করা হয়েছে। এখনও মামলার তদন্ত চলছে।
এদিকে গত ৮ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর ভাটারা এলাকার ছোলমাইদ ঢালীবাড়ি এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালমুখী সড়কের একটি ফুটপাত থেকে বস্তা ও কার্টনবন্দি অজ্ঞাত নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রযুক্তির সহায়তায় র্যাব ওই নারীর পরিচয় শনাক্ত করে। নিহত নারীর নাম শিপন আক্তার (৩৪)। পোশাক শ্রমিক শিপন যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করতেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ভাটারা থানায় দায়ের হওয়া শিপন হত্যা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। শিপন আক্তারের সঙ্গে গ্যারেজকর্মী আব্দুল জব্বারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সুযোগে যৌনকর্মী শিপনকে বাসায় নিয়ে সারা রাত রাখতে চেয়েছিল জব্বার। তবে শিপন চেয়েছিল বাসায় ফিরে যেতে। তাদের মধ্যে বাসায় থাকা ও টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। এরপর শিপনকে শ্বাসরোধে খুন করে জব্বার।
জব্বারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জব্বার পুলিশকে জানিয়েছে, শিপনকে হত্যার পর কার্টন ও বস্তায় ভরে লাশ সড়কে ফেলে রেখে যায় সে এবং তার বন্ধু। শিপনের মোবাইলটি বিক্রি করে ইয়াবা সেবন করে জব্বার ও তার বন্ধু হীরা।
যৌনকর্মীরা এভাবেই তাদের ভালোবাসার মানুষ, প্রেমিক, বাবু অথবা কথিত স্বামীর হাতে খুন হয় উল্লেখ করে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন জীবনের আলোর সভাপতি শাহানাজ বেগম।
তিনি বলেন, যৌনপল্লি কিংবা ভাসমান যৌনকর্মীদের কেউ না কেউ ‘বাবু’ বা ‘প্রেমিক’ থাকে। কেউ কেউ তাদের স্বামীও পরিচয় দেয়। এসব ব্যক্তি মেয়েদের উপার্জিত টাকায় ভাগ বসায়। কখনও কখনও মেয়েরা কিছু টাকা লুকিয়ে রাখে, সেই টাকাও বাবুরা হাতিয়ে নিতে চায়। তখন দ্বন্দ্ব হয়, খুন হয়। এসব ব্যক্তি মূলত দালাল প্রকৃতির। তারা মেয়েদের দিয়ে এভাবেই আয় করে।
শাহনাজ বেগম বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় যৌনকর্মীদের খুন করা হয়, কিন্তু কেউ হিসাব রাখে না। যৌনকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা সবসময় কথা বলে আসছি, কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না।
গত ৮ সেপ্টেম্বর শ্যামলীর ২ নম্বর সড়কের রাজ ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক হোটেলে এক ভাসমান যৌনকর্মী খুন হওয়ার বিষয়ে মামলা করেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মেয়েটি আমার সংগঠনের সদস্য ছিল। সে তার স্বামী বা বাবুকে শেওড়াপাড়ার বাসায় রেখে ফার্মগেট এসেছিল। ফার্মগেট থেকে এক খদ্দেরের সঙ্গে রাজ হোটেলে যায়। সেখানে খদ্দেরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব হয়। এরপর মেয়েটি সেখানে খুন হয়। মূলত বাবু বা দালালরা মেয়েদের বেশি উপার্জন করতে বাধ্য করে। তা না হলে তাদের নির্যাতন করে। কম টাকা দিলে বাবুরা বিশ্বাস করতে চায় না, বাধ্য হয়ে মেয়েরা খদ্দেরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ায়। তখন তাদের সঙ্গে এসব হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, শ্যামলীর ঘটনায় আমরা নিজেরাই মামলা করেছিলাম। কিন্তু আসামিরা টাকা দিয়ে জামিনে বের হয়ে এসেছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির পরিবারকে কিছু টাকা দিয়েছে, আমরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠিনি। যৌনকর্মীদের খুনের নেপথ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাবু বা কথিত প্রেমিক বা স্বামীরা দায়ী।
রাজ হোটেলে যৌনকর্মী খুনের ঘটনায় খুনিকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। তার নাম খোকন।
যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন বছরে অন্তত ৮ জন যৌনকর্মী খুন হয়েছেন। এরমধ্যে তিনটিই গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনগুলো। কারণ, সারা দেশের হিসাব কেউ রাখে না, কেবল নিজ নিজ সংগঠনগুলোর সদস্যরা হত্যার শিকার হলে হিসাব রাখে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন