Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ইসরাইলি ‘পেগাসাস’ দিয়ে আড়ি পাতা হয়েছে সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, রাজনীতিক নেতাদের ফোনেও

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০২১, ০১:৩৩ PM
আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২১, ০১:৩৩ PM

bdmorning Image Preview


পানামা পেপারসের পর এবার পেগাসাস প্রজেক্ট। পানামা পেপারস প্রকাশ করে দিয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর মানুষের অবৈধ অর্থের অফসোর বিনিয়োগের খবর। আর এবার পেগাসাস প্রজেক্ট প্রকাশ করে দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, কূটনীতিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, অধিকারকর্মী, ব্যবসায়ীর ফোনে আড়ি পাতার খবর। এ খবরে সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, কূটনীতিক সহ সারা বিশ্বে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কার ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। কি কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছে তা নিয়ে এক হিম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে চারদিকে। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে আইসল্যান্ডের তখনকার প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্দুর ডেভিড গানল্যাংসন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সুপ্রিম কোর্ট পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করে।

এবার সবার মধ্যে আতঙ্ক কার আবার কপাল পোড়ে! কোন কোন দেশে এই নজরদারি করা হয়েছে তা পরিষ্কার জানা না গেলেও সবচেয়ে বেশি ফোনকলে আড়ি পাতা হয়েছে ১০টি দেশে। এসব দেশ হলো আজারবাইজান, বাহরাইন, হাঙ্গেরি, ভারত, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, মরক্কো, রোয়ান্ডা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিশেষ করে জোর দেয়া হয়েছে সৌদি আরবের ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকা-ের পর ৩৭টি স্মার্টফোনে। এসব ফোন ব্যবহার করেন সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, ব্যবসায়ী নির্বাহী এবং দু’জন নারী। ইসরাইলের নজরদারীকারী প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ আবিষ্কৃত পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করে এই আড়ি পাতা হয়েছে। বিষয়টি প্রকাশ করেছে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট ও ১৫টি অন্যান্য মিডিয়া। এতে বলা হয়েছে, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো এনএসও গ্রুপের আবিস্কৃত পেগাসাস সফটওয়ার ব্যবহার করেছে আড়ি পাতার জন্য। স্পর্শকাতর এই সফটওয়্যার দিয়ে আড়ি পাতা হয়েছে ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনকে আক্রান্ত করে সেখান থেকে তথ্য চুরি করতে। এর মধ্যে প্রতিটি কন্টাক্ট নাম এবং ফোন নম্বর হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। টেক্সট ম্যাসেজ, ইমেইল, ফেসবুকের ম্যাসেজ, স্কাইপ, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, উইচ্যাট এবং টেলিগ্রামের সব তথ্য নিয়ে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তবে কোন কোন দেশের সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, তা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। এটা জানা গেছে বার্তা সংস্থা এএফপি, দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, ফ্রান্স ২৪, রেডিও ফ্রি ইউরোপ, মিডিয়াপার্ট, এল পাইস, এপি, লে মন্ডে, ব্লুমবার্গ, ইকোনমিস্ট, রয়টার্স ও ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিদের বিরুদ্ধে আড়ি পাতা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুযায়ী সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে টার্গেট করে হত্যা করার পর খাসোগির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এমন দু’জন নারীর বিরুদ্ধে আড়ি পাতা হয়েছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটের ভিতরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় খাসোগিকে। এর মাত্র কয়েকদিন পরেই তার বাগদত্তা হ্যাটিস চেঙ্গিসের ফোনে মেলওয়্যার পাঠিয়ে আক্রান্ত করা হয়। এরপর তার ফোনে আড়ি পাতা হয়।

বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে ইসরাইলের তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার 'পেগাসাস' ব্যবহার করে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর অনুসন্ধানে এ ঘটনা বেরিয়ে আসে। সংগঠন দুটি নাম ফাঁস হওয়া ব্যক্তিদের (যাদের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছিল) তালিকা বৃটেনের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের দ্য ওয়্যার সহ বিশ্বের ১০ টি দেশের মোট ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে শেয়ার করে। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ যাতে ৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিক যুক্ত ছিলেন। তাদের দাবি, পেগাসাস নামের স্পাইওয়ার অ্যাপ যা সাধারণত জঙ্গি কার্যকলাপের উপর নজরদারি চালাতে বা সামরিক গোয়েন্দাদের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেই অ্যাপ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গোপন নজরদারি চলছিল।

বৃটিশ প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পেগাসাস ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো 'টার্গেট' করে নিজ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিদের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল যাদের তারা হুমকি বলে মনে করে। এসব সরকার কোন না কোন সময় নাগরিক অথবা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অথবা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের উপরে গোপন নজরদারির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে।

এই দেশগুলোর মধ্যে বেশকিছু দেশের সরকার আবার পেগাসাস অ্যাপ-এর নির্মাতা সংস্থা এনএসও-র কাছ থেকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সির প্রযুক্তি কেনার গ্রাহক। ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে ওই স্পাইওয়ারের নির্মাতা সংস্থা এবং এই অ্যাপটিকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের লাইসেন্সও দিয়েছে ইসরাইল সরকার। এটা দিয়ে আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর অজান্তে তার বার্তা, ছবি, ইমেইল পাচার; কল রেকর্ড, মাইক্রোফোন চালু রাখা সক্ষম। এনএসও গ্রুপ অবশ্য বলছে, অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের উপর নজরদারি চালানো তাদের ওই স্পাইওয়্যার তৈরির লক্ষ্য। কিন্তু গোপনে ব্যবহার করতে বিভিন্ন দেশের সরকার এনএসও-র গ্রাহক হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অ্যামনেস্টির সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গার্নিয়েরি বলেছেন, “যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসও-র গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে। ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে। স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও এটি আশপাশ থেকে শব্দ গ্রহণ করতে থাকে।"

পেগাসাস প্রজেক্ট বলছে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের তালিকা তাদের অনুসন্ধানে সামনে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসও–এর গ্রাহকরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে। সেখানে অন্তত ৩৭টি (সিনিয়র সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিজনেস এক্সিকিউটিভস, সৌদি আরবের খুন হওয়া সাংবাদিক জামাল খাসোগি-র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুই নারী) এমন সেলফোন নম্বর রয়েছে যাদের উপর গোপন নজরদারি চালানোর একদম যথাযথ প্রমাণ রয়েছে।

টার্গেট করা ব্যক্তিদের তালিকা ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে পেগাসাস প্রজেক্ট এর সাথে জড়িত সংবাদমাধ্যমগুলো। প্রথম ধাপে প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ২১ দেশের (কমপক্ষে ১২ এনএসও গ্রাহক দিয়ে) ১৮০ জন সাংবাদিককে 'টার্গেট' করার কথা বলা হয়েছে যাদের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস এর মতো বিশ্বখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিকরা রয়েছেন। এনএসও গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারঃ বাহরাইন, মরক্কো, সৌদি আরব, ভারত, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি, আজারবাইজান, টোগো, রুয়ান্ডা।

ওই ১৮০ জনের মধ্যে ৩৮ জনই ভারতীয় সাংবাদিক যাদের অনেকেই হিন্দুস্তান টাইমস, নিউজ ১৮, দ্য হিন্দু এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো প্রথিতযশা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত। এর আগে রোববার সকালেই পেগাসাস আড়ি পাতছে এমন বিস্ফোরক দাবি করে এক টুইটে বিজেপি-র রাজ্যসভার সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী লিখেন, "আড়ি পাতা হচ্ছে দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ফোনে, মোদীর মন্ত্রিসভার সদস্যদের ফোনে, আরএসএস নেতাদের ফোনেও।" ভারত সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসেও আলোচনায় এসেছিল পেগাসাস। তখন পেগাসাসের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের অন্তত ১৪০০ ব্যক্তির ফোনে ইজরায়েলি প্রযুক্তি দিয়ে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠেছিল। বলা হয়েছিল- চারটি মহাদেশের কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে যার মধ্যে ছিল ভারত-ও। ২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপও পেগাসাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল।

Bootstrap Image Preview