পংকজ কুমার নাগ, মৌলভীবাজার:
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা বনবিভাগের আওতাভুক্ত রাজকান্দির চিরহরিৎ বনাঞ্চল উজাড় করে চলছে একদল বনদস্যু। অভিযোগ রয়েছে প্রায় প্রতিদিনই এই বন থেকে ৩০ থেকে ৪০টি মূল্যবান গাছ কেটে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে একটি কুচক্রী মহল। গত ২৯ জানুয়ারি (বুধবার) সরেজমিনে রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট ঘুরে দেখা যায়, কেটে ফেলা প্রচুর গাছের গুড়ি পরে আছে চারপাশে। এই গাছ গুলোর মধ্যে বেশিরভাগই রয়েছে অতি মূল্যবান সেগুন, গর্জন, লোহা কাঠ ও আকাশমনি গাছ।
গভীর অরণ্যের পাহাড়ি এই পথ ধরেই যেতে হয় দেশের অন্যতম জলপ্রপাত হামহাম। তাই প্রায় প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা হামহাম জলপ্রপাত দেখতে এই দুর্ঘম পাহাড়ি পথ ব্যবহার করে থাকেন। হামহাম ঘুরতে আসা এক পর্যটক দলের দলনেতা সোনালী রায়। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সোনালী রায় "বিডি মর্নিং"কে জানান, এই রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে যে হারে মূল্যবান বৃক্ষ নিধন চলছে দিনের পর দিন, এভাবে বৃক্ষ উজাড় হতে থাকলে খুব বেশি দিন বাকি নেই এই বন ধ্বংস হতে। কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জোড় দাবী জানান এ পর্যটক দল।
গাজী টিভির মৌলভীবাজার কোরেস্পন্ডেন্ট হৃদয় দেবনাথ জানান, জীববৈচিত্র্য আর গাছ-গাছালিতে ভরপুর লাউয়াছড়ার মতো রাজকান্দি ফরেস্টও দ্রুত উজাড় হতে চলছে। তাই দ্রুতই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবী জানান তিনি। রাজকান্দি রেঞ্জে অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী। দিনের পর দিন গাছ উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণীর খাদ্য সংকটও প্রবল আকার ধারণ করেছে।
অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বৃক্ষের পাশাপাশি অস্তিত্ব হারাবে প্রাণিকুল এমনটাই মনে করেন চ্যানেল ৭১ এর পরিবেশবাদী সাংবাদিক হোসেন সোহেল। হোসেন সোহেল বিডি মর্নিং কে বলেন, এই বৃক্ষ নিধন বন্ধ না হলে খুব দ্রুতই লাউয়াছড়ার মতো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট। দ্রুতই কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, দেশে যে কয়েকটি রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে তার মধ্যে রাজকান্দী অন্যতম তাই এই বন এবং বনের জীববৈচিত্র রক্ষা করতে এখনই কর্তৃপক্ষকে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বন এবং জীববৈচিত্র দুটিই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
এ বিষয়ে খোদ বন বিভাগের লোকজনকেই দায়ী বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। একজন স্থানীয় পর্যটক গাইড হিসেবে কাজ করেন আসলাম মিয়া। তিনি বলেন, ট্যুরিস্ট গাইড হবার কারণে মাসের বেশিরভাগ দিন, বিশেষ করে শীতের মৌসুমে আমি পর্যটকদের নিয়ে হামহাম জলপ্রপাতে যাই। অবাক করা বিষয় হচ্ছে লাউয়াছড়ায় যখন চুরি হয় সাধারণত রাতের বেলা কিংবা গভীর রাতকেই টার্গেট করে এসব চোরচক্র। কিন্তু রাজকান্দি ফরেস্টে দিনের বেলায়ই পর্যটকদের সামনে দিয়ে মূল্যবান গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে চোরচক্র। তবে তাদের সাথে দেশীয় অস্ত্র থাকায় আমরা প্রতিবাদ করিনা। "জানের মায়া তো সবারই থাকে তাইনা"।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক লোক অভিযোগ করে বলেন, অবৈধভাবে বৃক্ষ উজাড়ে চিহ্নিত কুচক্রী মহলকে সহায়তা করছেন খোদ বনবিভাগেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। হামহাম জলপ্রপাত দেখতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সেলিম আহমেদ বলছেন, এখনই গাছ চুরি রোধ করা না গেলে খুব দ্রুতই ভারসাম্য হারাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ। যদিও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বনবিভাগের রাজকান্দি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবু তাহের।
মৌলভীবাজার কমলগঞ্জের ভারত সীমান্তঘেষা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুরমা বন বিটের অবস্থান। দেশের নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয়, নয়নাভিরাম জলপ্রপাত হামহাম এর অবস্থানও এখানেই। হামহাম জলপ্রপাতে যাবার পথেই চোখে পড়ে অসংখ্য বড় বড় কাটা গাছের গুড়ি। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিনই এখান থেকে চুরি হয় ২০ থেকে ৩০ টি গাছ। এমনকি নিধন করা হচ্ছে বিভিন্ন বন্য প্রাণীও। স্থানীয়রা বলছেন, আমাদের হিসেবে প্রতিদিন আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০টা গাছ এবং প্রচুর পরিমানে বাশ এই বন থেকে রাতের আঁধারে পাচার হয়ে যায়। দিনের বেলাতে চুরি হলেও রাতের বেলা বেপরোয়া হয়ে ওঠে ঐ চোর চক্র। বনবিভাগের লোকজনের পাহারা থাকা সত্ত্বেও এত গাছ কিভাবে চুরি করে নিয়ে যায় এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বিডি মর্নিং কে আস্বস্ত করে বলেন, বনবিভাগের সাথে কথা বলে বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, যদি অবৈধ ভাবে বনের গাছ কাটা হয় তবে আমরা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্ট আকর্ষন করবো, এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।
এদিকে রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবু তাহের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার জানামতে এমন কোন অনিয়ম এই রাজকান্দি ফরেস্টে নেই। আমি এবং আমাদের অনেক স্টাফদের প্রায়ই এই ফরেস্টে আসা যাওয়া আছে। চোরচক্রের হাত থেকে এই বন রক্ষায় আমাদের লোকজন সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের বনবিভাগের প্রত্যেকেই সতর্ক অবস্থায় কাজ করছি বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন যেহেতু অভিযোগ পেয়েছি, এ অভিযোগটি আমি দ্রুতই খতিয়ে দেখবো ।
পংকজ কুমার নাগ
মৌলভীবাজার
+৮৮০১৭১৬-৫৬৩৪৬৮