চলতি মাসে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশবাদি নীতি ও কৌশল গবেষণা সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জনবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে মানবসভ্যতা। যা ইতিপূর্বে দেয়া পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশংকার বিষয়টিকে আরো জোরদার করে তুলেছে।
তবে ইতিপূর্বে প্রকাশিত অন্যান্য গবেষণা প্রতিবেদনের মতো এখানে শুধু সম্ভাবনার কথায় আলোচনা করা হয়নি, বরং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত মানুষ যেসব বিপদকে নিতান্তই দূরের বিষয় বলে ভাবছে, সেগুলো যে কতো বড় কঠিন সত্য হবে আগামী দিনে, তা তুলে ধরা হয়েছে। আলোচিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি বাড়বে।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত আইপিসিসি বা জাতিসংঘের ইন্টার গর্ভমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রতিবেদনে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলা হয়েছিলো। তবে ব্রেক থ্রু ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে দাবী করা হচ্ছে, তার চাইতেও কম সময় বা ২০৪৫ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে।
যার নেপথ্যে অবদান রাখবে তিনটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উৎস। প্রথমটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। এটা হলো শিল্প, পর্যটন, বাণিজ্য, আবাসন ও অন্যান্য উৎস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের অব্যাহত নিঃসরণ। দ্বিতীয়টি আসবে ভূমি থেকে। কৃষিকাজ এবং অন্যান্য কর্মকা-ের জেরে পৃথিবীর মাটি থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন বায়ুম-লে মিশছে।
একইসঙ্গে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা পারমাফ্রস্ট গলে মিথেন নিঃসরণ বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। যার গতি আগামী দিনে আরো তীব্র হবে। তৃতীয় প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রস্রোতের গতি ও দিক পরিবর্তন।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির নানা ত্রুটির কথাও তুলে ধরেছে আলোচিত প্রতিবেদনটি। এখানে বলা হচ্ছে, প্যারিস চুক্তি প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করলে ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ২১০০ সাল নাগাদ ৩ ডিগ্রি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, ধীরে ধীরে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এখানে কার্বন চক্রের ধারাবাহিকতাকে গণনা না করার কারণে সঠিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনুমান করা হয়নি।
আলোচিত প্রতিবেদনটি আরো বলছে, জলবায়ু ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ভয়ংকর দিকগুলো এখনই পৃথিবীর পানীয় উৎসের সংকট, ফসল উৎপাদন সংকট, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকট হয়ে উঠেছে। এই বিষয়গুলো এখন বিশ্বব্যাপী সামাজিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, চরমপন্থার উত্থান এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার মাগরেব এবং সাহেল অঞ্চল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে ইউরোপে শরণার্থীদের ভিড়ও বাড়ছে।
যার উপর ভিত্তি করে নব্য নাৎসিদের মতো কট্টর ডানপন্থীরা ইউরোপে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হচ্ছে। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ইতালি যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমনকি জার্মানির মতো বৃহৎ দেশেও এখন নব্য নাৎসিরা প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। এই পরিস্থিতি শুধু সংঘাতকেই উস্কে দেবে না বরং পৃথিবীকে পরমাণুযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখিও করতে পারে। পরমাণুযুদ্ধ যদি নাও হয়, তবুও নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই।
এইভাবে বিশ্বের তাপমাত্রা যদি বাড়তেই থাকে, তবে বিজ্ঞানীরা একে একটি হট হাউজ পরিস্থিতি বলে উলে¬খ করেছেন। এর ফলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার সকল বরফ গলে যাবে। আর জমবে না এর অ্যান্টার্কটিকার সামুদ্রিক বরফ। বর্তমানের চাইতে ২ ডিগ্রি বাড়লে গ্রিনল্যান্ডের সকল হিমবাহ গলে যাবে। গলে যাবে সব পারমাফ্রস্ট। আর আড়াই ডিগ্রিতে মহাবন অ্যামাজন তীব্র ক্ষরার মুখে পড়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা পড়বে।
এর ফলে ২০৫০ সালের ভেতর সাগরের উচ্চতা আরো দশমিক ৫ মিটার বাড়বে। ২১০০ সাল নাগাদ বাড়বে আরো ৩ মিটার। বিশ্বের ৩৫ শতাংশ স্থলভূমি এবং ৫৫ শতাংশ জনসংখ্যা তখন প্রতিবছর টানা ২০ দিন ধরে তীব্র দাবদাহের কবলে পড়বে। যেই দাবদাহ সহ্যের ক্ষমতা পৃথিবীর কোন মানুষের নেই। তবে এই দাবদাহের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাবে পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে, মধ্যপ্রাচ্যে এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। এসব অঞ্চলে দাবদাহ বছরে অন্তত ১০০ দিন ধরে তা-ব চালাবে, ফলে মুষ্টিমেয় যে কয়টি সুপেয় জলের উৎস থাকবে সেগুলোও শুকিয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাপী ২০০ কোটি মানুষ তীব্র পানীয় সংকটে পড়বে। আর উপক্রান্তীয় অঞ্চল কৃষিকাজের স¤পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে উঠবে। মেকং, গঙ্গা ও নীলের মতো বিখ্যাত নদনদীগুলো তখন মরে যাবে একেবারেই। সেদিন চেন্নাই, মুম্বাই, জাকার্তা, গুয়ানজু, তিয়ানজিন, হংকং, হো চি মিন সিটি, সাংহাই, লাগোস, ব্যাংকক এবং ম্যানিলার মতো জনবহুল নগরীগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে।