ফারজানা ইয়াসমিন।।
জনপ্রতিনিধি নজির আলী এবারো ভোট প্রার্থী। আর মাত্র ৪ দিন পরেই ভোট। একাদশ সংসদ নির্বাচনে এবারো তাকে জিততেই হবে। চিন্তায় পড়ে গেল নজির আলী। উপায় খুঁজলেন নতুন বুদ্ধির। সকাল বিকাল চিন্তা করে সময় নষ্ট করার মতো বোকামীতে যেতে চাচ্ছে না নজির আলী। টাকা যেহেতু আছে সেহেতু এত চিন্তার কারণ নাই, নজির আলী ভাবেন। আচার ব্যবহারে পরিবর্তন আনলেন তিনি। পোশাক-আশাক খাওয়া দাওয়া আতিথেয়তায়ও অনেক পরিবর্তন এনেছেন তিনি। দেখে বোঝাই যাবে না ১০ বছরের দেখা নজির আলী এত তাড়াতাড়ি এত পরিবর্তন কিভাবে করলেন নিজেকে। নজির আলীর পরিবর্তন ভোটারদের মাথায় চিন্তার পোকা ঢুকালো।
নজির আলীকে দেখলে এখন আর মনে হবে না তার দ্বারা কখনো কোনো অন্যায় কাজ করানো সম্ভব। সকলের সাথে হাসি-খুশি দেখলে যেকারো মনে হবে জন্মগত ভাবে বোধহয় হাসিমাখা ঠোঁট দুটো পেয়েছেন নজির আলী। কেউ ভালো আচরণ করবে হেসে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক ধরে নিচ্ছেন সবাই। কিন্তু নজির আলীর এই স্বাভাবিক চলাফেরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না অনেকেই। এর আগেও তিনি নির্বাচন করেছেন। এবার নজির আলীর চেষ্টার কমতি নেই। বিপদের কথা শুনলেই সবার আগে এখন ছুটে যান নজির আলী। নজির আলী জয় করলেন কিছু মানুষের হৃদয়। চারদিকে এখন তার সুনামের ছড়াছড়ি। কিন্তু নজির আলী কি এই সুনামে একটুও বিরক্ত নন?
সবার কাছে এখন তিনি দেবতা সমান। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, নজির আলীর ব্যস্ততা ও শ্রম ততই বেড়ে যাচ্ছে। দান খয়রাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। মানব সেবায় এ কদিনে যে নজির আলী সবার দেবতাতুল্য উপাধি পেলেন, ভোটতো সে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। নজির আলী মোটেও চিন্তিত নন জয় নিয়ে। তবুও ভোটের চিন্তা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। না ঘুম, না খাওয়া। মধ্যরাতেও ঘুম থেকে ওঠে চলে যান বিধবা পল্লিতে। সুযোগ পেলেই মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভোট চেয়ে জড়িযে ধরেন বুকে। তাকে যেই দ্যাখে, সেই বলে ভাই এবার ভাবছি ‘না ভোট’ দিমু, কিন্তু আপনি যেহেতু ভোটে দাঁড়ালেন, অন্তত এই সুযোগটা আর থাকছে না। নতুন ভোটাররা বলে ভাই জীবনের প্রথম ভোটটি আপনাকে দিয়েই গণতন্ত্র সূচনা করতে চাই। কতবছর পরে ভোট আসলো। আমাদের ভোটটা অন্তত আপনাকে না দিলে মরেও শান্তি পাবো না। ১০ বছরে আপনার সেবায়, প্রতিশ্রতে আমরা গর্বিত। নজির আলীর মুখে পূর্ণিমার হাসি।
নজির আলী ভোট দেয়ার অঙ্গীকার নিলো এলাকাবাসীর। ২৪ পাতার নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ওয়াদাও করলেন নজির আলী।ভোটের দিন দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলেন সবার। আগে খাবে তার পরে ভোট দিবে। খালি পেটে কারো ভোট দিতে দিবেন না নজির আলী। নিজেই বেড়ে গুড়ে খাওয়াচ্ছেন সবাইকে। ভোট দিতে যাবার আগে বহু ভোটারই দিনের প্রথম হাস্যোজ্জল নজির আলীকে দেখে বিজয়ের মিষ্টি খাওয়ার কল্পনা করতে লাগলো। রফিক মিয়া ভোট দেবার আগে যখন নজির আলীর সাথে শেষ হাত মেলালেন, তখন বিএসসি পাশ করা ছেলের চাকুরির কথাটা আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন। যে যাই বলুক নজির আলীর মাথা দুদিকেই নড়ে। দশ বছর যা করেননি এবার সবই করে দেবেন তিনি।
ওদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর, বিকেলে শেষ ভোটটি নেওয়া হলো প্রতিবন্ধী আম্বিয়ার মায়ের। বেচারার একটি প্রতিবন্ধী কার্ড ই দাবি ছিল এই ১০ বছরে। নজির আলী মাথা নাড়িয়ে বললো আজতো জয়ী হয়ে যাচ্ছি। কাল কাউকে পাঠিয়ে দিয়ো। আমি ব্যবস্থা করে দিবো। আর শুন বাড়ি যাবার সময় আমার বাড়িতে আবার খেয়ে যাবে কিন্তু।
ভোট গণণা চলছে। নজির আলীর চোখে মুখে খুশির ঝলক। ভোট গণনা যতই শেষ হচ্ছে নজির আলী ততই খুশি। এখন আর কোন চিন্তা নেই তার। হাতে নতুন কিছু টাকা দিয়ে বাদলকে আতশবাজি আর রং কিনে আনতে পাঠালেন তিনি। পাশে দাঁড়ানো রহিমকে ডেকে বললো এত দেরি হচ্ছে কেন? দেখতো রং আর পটকা নিয়ে আসতে এত দেরি করলে হবে? আমাদের সারাগ্রামে মিছিল করতে হবে। আমি জয়ী হইছি এই কথা আজ পটকার আওয়াজেই আমার নেত্রীকে জানান দিবো। দেখ মিডিয়াগুলো অপেক্ষা করছে। রহিমও এবার নজির আলীর মতো মাথা নাড়লেন।
মিনিট দুয়েক পরে রহিম চলে গেল। কেউ নেই নজির আলীর পাশে। ভোট গণণা শেষ। প্রিজাইডিং অফিসার বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছেন নজির আলীর দিকে। একে একে সবার ভোট ঘোষণা করা হলো। বাকি আছে নজির আলী।
সবাই নজির আলীর ভোটের ফলাফল নিয়ে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে পড়লো। পিছন থেকে রহিম এসে বললো এমপি সাহেব রং পটকা সবই এসে গেছে। ফুটাতে বলবো। নজির আলী চিৎকার দিয়ে বললো ওরে বেটা ফুটাবি না তো কি করবি। আমি কি এই সব বাসায় নিতে কিনে আনতে বলছি। দাঁড়াও! এক মিনিট ওয়েট কর। এই এখনই আমার নাম ঘোষণা করা হবে। আগে ফলাফলটা একটু শুনতে দে।
নজির আলীর অপেক্ষার পালা শেষ। নজির আলী একটি মাত্র ভোট পেয়েছেন। হাসি মাখা মুখ লালনীল হয়ে গেলো। চোখ অন্ধকার হয়ে গেল নোনাজলে। বিজয় নিয়ে মিছিল করতে লাগলো বিজয়ীরা। সবাই এবার বিজয়ের মালার মিছিল দিচ্ছেন বিজয়ীকে। স্লোগানের লাইনটা হঠাৎ ই লম্বা হয়ে গেল। রহিমও সেই মিছিলে যোগ দিলো। বাদল পটকা ফুটাচ্ছে মনের আনন্দে। কারো কোন দু:খ নেই। সবার কাছে নজির আলী বড়ই অপরিচিত হয়ে গেল হঠাৎই। আম্বিয়ার মাও হুইল চেয়ারে বিজয়ীর স্লোগান দিচ্ছে পিছুপিছু। মিছিল যাচ্ছে রাস্তা থেকে রাস্তায়। নজির আলীর বাড়ির শেষ মাথাটাও একটু আগে অতিক্রম করলো বিজয়ীর মিছিল। সবই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন নজির আলী।
১০ বছর পরে এতবড় মিছিলের মালিকানা হারালো নজির আলী। হঠাৎই তার মনে পড়লো এতবড় মিছিল নিয়েইতো আমি ক্ষমতায় আসছিলাম। কিন্তু এত মারলাম, এত মামলা দিলাম, এত ভয় দেখালাম তারপরও ওদের বিজয় ঠেকানো গেল না। আমার মৃত্যু সনদও বুঝি তাদের কাছ থেকে নিতে হবে? নজির আলী বসে পড়ে মাটিতে। ১০ বছরের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের হাহাকার নজির আলীকে অপরাধী করে তোলে ভীষণ। পৃথিবীর বুকে নজির আলী নিজের মতো এত অসহায় কাউকে আর কখনো দেখেনি। এমনকি আম্বিয়ার মাকেও না।