Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

তিনটি সেতু বদলে দিয়েছে পর্যটননগরী কুয়াকাটাসহ মৎস্যবন্দরের অর্থনৈতিক চিত্র

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ০৫:৫৭ PM
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ০৫:৫৭ PM

bdmorning Image Preview


জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী প্রতিনিধিঃ

তিনটি সেতু বদলে দিয়েছে পর্যটননগরী কুয়াকাটা ও দেশের বৃহৎ মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুরের অর্থনৈতিক চিত্র। সাগরকন্যা বেড়েছে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ। গড়ে উঠেছে বহুমাত্রিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সারা বছরই থাকছে পর্যটকদের উপস্থিতি। দীর্ঘ বছরের প্রত্যাশার এ তিনটি সেতু র্নিমানে স্থানীয় জীবনযাত্রায় এনেছে আর্থিক সাবলম্বীতা। বদলে দিয়েছে জীবনমান। জনজীবনে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। আর এর সব কিছুই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এমনটাই মনে করছেন সংশিস্টরা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরশহর থেকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত মাত্র ২২ কিলোমিটারের সড়কের আন্ধারমানিক নদী, সোনাতলা নদী ও শিববাড়িয়া নদীতে ফেরী পারাপারে পর্যটকসহ স্থানীদের পন্য পরিবহন ও য়োগাযোগে পোহাতে হত নানা দুর্ভোগ। পর্যটনশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্বেও শুধুমাত্র যাত্রপথের ভোগান্তির কারনে সূর্যোদয়, সূর্যাস্তসহ প্রকৃতির আপর ছোয়ায় নীল নিলীমার প্রতিচ্ছবি কুয়কাটার পর্যটন শিল্পেও ছিল অনেকটা স্থবির। ফলে এ তিনটি নদীর উপড় সেতু র্নিমাণ দাবি ছিল এ অঞ্চলের মানুষসহ কুয়কাটায় বিনিয়েগকারী ও মৎস্যখাতের ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ দিনের।

পৃথিবীর বিরলতম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং বিড়ম্বনাহীন ভ্রমণ এবং কুয়কাটার পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনসহ মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরের অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং সবজী পল্লীখ্যাত নীলগঞ্জের আর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তি প্রচেস্টায় উদ্যোগ নেয়া হয় তিনটি সেতু নির্মাণের।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অন্ধারমানিক নদীর উপড় প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট গার্ডারের ১৯টি স্পানের ওপর শেখ কামাল সেতুটির র্নিমাণ কাজ শুরু হয় করা ২০১০ সালে। ৮৯২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০.২৫ মিটার প্রস্থ সেতুটির দুই দিকে রয়েছে চারশ' মিটার সংযোগ সড়কসহ এর র্নিমাণ ব্যায় ধরা হয় ৬৫ কোটি ১ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। সোনাতলা নদীর ওপর শেখ জামাল সেতু নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ৭ মার্চ মাসে কার্যাদেশ দেয়া হয়।

১০টি স্প্যানের উপরে নির্মিত এ সেতুর দৈর্ঘ্য ৪৮৩ মিটার। এই সেতুটির সংযোগ সড়ক রয়েছে দুই দিকে ৪০০ মিটার। সেতুটির নির্মাণ ব্যয় রয়েছে ৬৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেক মুজির রহমানের দুই সন্তানের নামে নির্মিত শেখ কামাল ও শেখ জামাল সেতু দুটি ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অপরদিকে, উপজেলার শিববাড়িয়া নদীর ওপর নির্মিত শেখ রাসেল সেতুর দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন সম্পন্ন শেষে কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০০৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি। কার্যাদেশ পেয়ে একই বছরের ৬ অক্টোবর এর র্নিমান কাজ শুরু করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। টিএসএল-আরইবি নামক দু'টি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে সম্পন্ন করে এর নির্মান কাজ। ৪০৮ দশমিক ৩৬ মিটার দীর্ঘ সেতুটির দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক রয়েছে ৪০০ মিটার। যার মোট নির্মাণ ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে ২৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট ভিািডও কনারেন্সের এর মাধ্যমে শেখ রাসেল সেতুর দ্বার উম্মুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সেতু তিনটি উম্মক্ত হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষ এবং পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা ভ্রমণে আসা দেশ-বিদেশি পর্যটকদের যোগাযোগ নতুন দিগন্তের উম্মোচন হয়। শত ভাগ তরান্বিত হয় মৎস্যবন্দর কুয়াকাটা-আলীপুর-মহিপুরের বানিজ্যিক কার্যক্রম। কুয়কাটায় বেড়েছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। যেখানে কর্মসংস্থান ঘটেছে কয়েক হাজার মানুষের। বেড়েছে সরকারের রাজস্ব আদায়।

কুয়কাটা পৌর মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা জানান, প্রকৃতির অপার দৃশ্য সবুজ বনানী আর বিশাল সমুদ্রের নীল জলরাশির জন্য সাগরকন্যা কুয়াকাটার প্রতি দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটকের রয়েছে আলাদা টান। প্রতি বছরই থাকত ব্যাপক পর্যটকের উপস্থিতি। কিন্তু তিনটি নদীর উপড়ে সেতু না থাকায় ফেরী পারপারের ভোগান্তির কারনে একবার যারা আসত পুনর্বার আর তারা আসত না। এর নেতিবাচতক প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল কুয়কাটার পর্যটন শিল্পে। অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী বিবেচনা ও দিক নির্দেশায় কুয়কাটা পর্যটন শিল্পের এখন আর সে দুর্দিন নেই। এখন এখানকার বাণিজ্যে বইছে সুদিনের হাওয়া।

কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওসার্ন অ্যাসেশিরয়শনের সেক্রেটারী জেনারেল মোতালেব শরীফ বলেন, কলাপাড়া-কুয়াকাট ২২কি.মি সড়কে তিনটি নদীর উপড় তিনটি সেতু র্নিমাণসহ সারা দেশের সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় এখন সারা বছরই কুয়কাটায় থাকছে পর্যটকদের উপস্থিতি। বিশেষ করে পর্যটন মৌসুম এবং বিভিন্ন ছুটির দিন গুলোতে হোটেল-মোটেল এবং রিসোর্টগুলোতে পর্যটকদের থাকার জায়গা দেয়া যায় না।

কুয়াকাটার অভিজাত হোটেল শিকদার রিসোর্ট এন্ড ভিলার জেনারেল ম্যানেজার জয়নুল আবেদীন গোলদার জানান, কুয়াকাটা পর্যটনকে নির্ভর করে শিকদার রিসোর্ট এন্ড ভিলা ইতোমধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি বিনিয়োগ করেছে। আগামী বছর এ বিনেয়োগ প্রায় দ্বিগুণ হবে। পর্যকদের উপস্থিতির কারনে বাড়ানো হয়েছে এ বিনিয়োগ উদ্যোগ।

তিনি আরো জানান, কুয়কাটার প্রাকৃতিক রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ একই পর্যটক বার ছুটে আসছে কুয়কাটায়। দুইদিন উপস্থিতির কথা থাকলেও অনেকেই তিন চার দিন থাকছে।

কুয়াকাটা-আলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, বঙ্গোপসাগরভিত্তিক মৎস্য আহরণের জন্য দেশের অন্যতম বৃহৎ মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুর। কিন্তু যাত্রাপথের ভোগান্তিসহ বিলম্বের কারণে অনেক ব্যবসায়ী মাছ নস্ট হয়ে যেত। এভাবে লোকসানের বোঝায় পথে বসে গিয়েছিল অনেকেই। কিন্তু সেতু তিনটি র্নিমাণের ফলে সেই ব্যবসায়ীরাই এখন লোকসান ঘুচিয়ে লাভের মুখে রয়েছেন।

নীলগঞ্জের সবজি চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, সারা বছর রোদে পুড়ে, বৃস্টিতে ভিজে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর সবজি উৎপাদন করি। কিন্তু যাতায়ত ব্যবস্থা ভাল না থাকায় উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পেতাম না। এখন আর সেদিন নেই। ন্যায়্য মূল্য পাওয়ার ফলে সবজি চাষের জমির পরিমাণ বাড়িয়েছি। আমার মত অনেকই তাদের সবজি চাষের জমি বাড়িয়েছেন। নতুন করে অনেকেই সবজী চাষে এসেছেন।

পরিবহন ব্যবসায়ী নাহিদুল ইসলাম জানান, এক সময় কুয়কাটায় আগত পর্যটকসহ সাধারন মানুষের রাজধানীসহ দেশের কোথায়ও যাওয়ার একমাত্র লক্কর ঝক্কর মার্কা বাসই ছিল নির্ভরশীল। সেতু তিনটি নির্মাণস সড়কপথ উন্নত হওয়ায় দেশের নামীদামী পরিবহন বাসসহ ভাল মানের বাস এখন চলাচল করছে।

গণমাধ্যমকর্মী মনিরুল ইমলাম বলেন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশের উন্নয়ের মূল চালিকা শক্তি। এক সময়ের এ অবহেলিত জনপদের যোগায়োগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক নতুন দিন্তের দ্বার উম্মোচন করেছেন। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক গতিশীলতা তৈরি করে দিয়েছেন। যার প্রভাব এ অঞ্চলের মানুষের জনজীবনে বইছে। অন্ধারমানিক নদীর উপড় কলাপাড়ার বালিয়তলী পয়েন্টে র্নিমিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় সেতুর র্নিমাণ কাজ সমাপ্ত হলে এ অঞ্চলের চিরচেনা অর্থনৈতিক, সামাজিক রূপ পাল্টে যাবে।

Bootstrap Image Preview