Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

চাঞ্চল্যকর ৪ হত্যা মামলার তদন্ত কোন পথে কেউ জানে না

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২১, ০৩:২০ PM
আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১, ০৩:২০ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


কুমিল্লায় গত সাড়ে ৫ বছরে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর ৪টি হত্যা মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ভুক্তভোগী পরিবার। ২০১৬ থেকে '২০ সালের মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটলেও একটি মামলারও চার্জশিট দিতে পারেনি সংশ্নিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলো। প্রতিটি মামলার তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হলেও মন্থর গতি কাটছে না। শুধু একটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে বলে দাবি করেছেন এর কর্মকর্তা।

নিহতদের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন, যুবলীগ কর্মী জিল্লুর রহমান জিলানী ও ব্যবসায়ী আক্তার হত্যাকাণ্ড ঘটে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) এলাকায়। এসব হত্যার নেপথ্যে ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। অপর ঘটনাটি ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্সের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর নির্মম হত্যা। এর মধ্যে আক্তার হত্যা মামলা সিআইডি এবং অপর ৩টি মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সমকাল ৪টি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সবারই দাবি- তদন্তে 'অগ্রগতি' হয়েছে।

তনু হত্যা মামলা: ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি জঙ্গল থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন তার বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। থানা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডির পর বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআই-ঢাকা। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে দু'দফায় তনুর ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে 'মৃত্যুর কারণ' নির্ণয় করতে না পারার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান চিকিৎসকরা।

গত প্রায় সাড়ে ৫ বছরে তনুর মৃত্যু নিয়ে তদন্ত সংস্থাগুলোর একেক সময় একেক বক্তব্যে নানা রহস্যের জন্ম হয়। ডিএনএ রিপোর্টে ঘাতকরা চিহ্নিত হবে-হচ্ছে, এমন আশার কথা একাধিকবার জানিয়েছিল সিআইডি। অবশেষে গত বছর নভেম্বরে সিআইডি কুমিল্লা থেকে মামলার নথি পিবিআই ঢাকায় হস্তান্তর করা হয়।

পরে তিন দফায় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসে আসেন মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-ঢাকার পরিদর্শক মজিবুর রহমান। তিনি মামলার সাক্ষী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সেনানিবাসের ভেতর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। মামলার অগ্রগতি বিষয়ে রোববার দুপুরে তিনি সমকালকে বলেন, মামলার নথি পর্যালোচনায় এরই মধ্যে কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ঢাকা সিআইডি অফিসে তনুর ডিএনএ রিপোর্ট চেয়ে ইতোপূর্বে পত্র পাঠানো হলেও তা হাতে আসেনি। মামলার তদন্তে কিছু অগ্রগতি আছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

তবে তনুর ছোট ভাই রুবেল সমকালকে বলেন, মামলার তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে পিবিআই তাদের কিছুই জানাচ্ছে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি দ্রুত মামলার চার্জশিট দাবি করেন।

ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হত্যাকাণ্ড: ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে স্থানীয় চৌয়ারা বাজারের ইজারা সংক্রান্ত আধিপত্য নিয়ে নগরীর শামবক্সি এলাকায় সন্ত্রাসীরা মাথায় গুলি চালিয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই শাহাদাত হোসেন নয়ন বাদী হয়ে একই গ্রামের রেজাউল করিম, কাউছারসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যায় শীর্ষ সন্ত্রাসী রেজাউল। সদর দক্ষিণ মডেল থানার পর বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই-কুমিল্লা। এ মামলায় গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর পিবিআই নগরীর নোয়াগ্রাম এলাকার আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারের পরই রহস্যের জট খুলতে থাকে। তিনি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দেলোয়ার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে দেলোয়ার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিনি নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সাত্তারের নাম প্রকাশ করেন।

কাউন্সিলর সাত্তারকে গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করার পর তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি এ হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। পরে তাকে এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে এনে অনেক তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে পিবিআই। এদিকে এ মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী রেজাউল গত জুনে সদর উপজেলার গোলাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বিজিবি তাকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে দেলোয়ারসহ ৪টি হত্যা এবং ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদকের ৩২টি মামলা রয়েছে।

ওই সন্ত্রাসীদের ভয়ে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে এখনও ভয় ও আতঙ্কে সময় অতিবাহিত করছেন দেলোয়ারের স্ত্রী জিলকজ আক্তার। মামলার বাদী নয়ন বলেন, প্রায় ৩ বছরেও আমার নিরপরাধ ভাইয়ের হত্যা মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়নি। হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট ও বিচার দাবি করছি।

তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-কুমিল্লার পরিদর্শক মতিউর রহমান বলেন, এ মামলার প্রধান আসামি এবং কারাগারে থাকা সন্ত্রাসী রেজাউলকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ঘটনার মোটিভ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। দুয়েক মাসের মধ্যেই হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।

যুবলীগ কর্মী জিলানী হত্যা: ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর সদর দক্ষিণ উপজেলার পুরাতন চৌয়ারা বাজারে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা যুবলীগ কর্মী জিল্লুর রহমান জিলানীকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ২৪ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই ইমরান হোসাইন চৌধুরী। শুরুতে থানা পুলিশ এবং গত বছরের নভেম্বর থেকে মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই-কুমিল্লা। মামলার আসামি কুসিকের ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাত্তারকে গত জানুয়ারিতে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ ছাড়াও গত মার্চে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কুমিল্লার আদালতে জামিন চাইতে গিয়ে কারাগারে যান নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসান। পরে জামিন চাইতে গিয়ে কারাগারে যান ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর খলিলুর রহমান। তবে বর্তমানে ওই ৩ কাউন্সিলরই জামিনে রয়েছেন। সর্বশেষ এ মামলায় গ্রেপ্তার হন এমদাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি। পিবিআই গত ২ আগস্ট মহানগরীর চৌয়ারা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

মামলার বাদী ইমরান বলেন, প্রকাশ্যে দিনের বেলায় তার ভাইকে হত্যা করা হয়। জড়িতদের শনাক্ত করা কঠিন কিছু নয়। তাদের পরিবারকে সারাক্ষণ সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হচ্ছে। অবিলম্বে ঘটনায় জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের গ্রেপ্তারসহ তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাবি করেন তিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-কুমিল্লার পরিদর্শক বিপুল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া এবং নেপথ্যের ব্যক্তিদের বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এ মামলায় এজাহারনামীয় আসামিদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক পদ-পদবি আছে। তাই প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই আরও একাধিক আসামিকে গ্রেপ্তারের পরই মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। চলতি বছরের মধ্যেই চার্জশিট দেওয়া হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

ব্যবসায়ী আক্তার হত্যা: কুমিল্লা নগরীর ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন হত্যার পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। থানা পুলিশ এক বছর তদন্তের পর বর্তমানে যুক্ত হয়েছে সিআইডি-কুমিল্লা। নিহতের বড় ছেলে সোহেল রানা জানান, গত বছরের ১০ জুলাই নগরীর কোটবাড়ি রোডের চাঙ্গিনী জামে মসজিদের বারান্দায় জুমার নামাজের পর তার বাবাকে প্রকাশ্যে শত শত মুসল্লির সামনে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী রেখা বেগম বাদী হয়ে কুসিকের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন, তার ৫ ভাইসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলা করেন। ঘটনার দিনই পুলিশ কাউন্সিলর আলমগীরের তিন ভাই আমির হোসেন, বিল্লাল হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। পরে উচ্চ আদালত থেকে সব আসামি জামিন লাভ করে।

তদন্ত বিষয়ে সিআইডি কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার খান মুহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, মামলাটি তাদের কাছে হস্তান্তরের পর তারা একাধিকবার ঘটনাস্থলে গিয়ে তথ্য-উপাত্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নিয়েছেন। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।

সূত্রঃ সমকাল 

Bootstrap Image Preview