Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নিজে না খাও, মোরে আরও আরও দাও ইলিশ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:১১ PM
আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:১১ PM

bdmorning Image Preview


 

ফারুক ওয়াসিফ।। 

‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’, একজন গাইছিল রবীন্দ্রনাথের গান। ঘরে ছিল বাজারফেরত তার বেজার বন্ধু। সে কটমট করে বলে উঠল, ‘প্রাণ কী রে, বল মোরে আরও আরও আরও দাও ইলিশ’! আগে প্রতিবছর ভারতে ইলিশ রপ্তানি হতো ৫০০ টন করে। এবার শুরুতে বলা হলো, রপ্তানি হবে দুই হাজার টনের কিছু বেশি। শেষমেশ দেখা গেল ইলিশ যাচ্ছে ৪ হাজার ৬০০ টন! অতএব, কালীগঙ্গাপারের বাসনা খাতুনের এবার ভালো করে ইলিশ খাওয়া হয়নি। যা খেয়েছেন তা জাটকা-জাতীয় ছোট ইলিশ। তাঁর মতো অনেকেই আছেন, ইলিশ যাঁদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে ভারতমুখী হয়েছে। তবে নদীপথে নয়, নদীতে কি আর সেই জলের টান আছে? জলপথের ইলিশ স্থলপথে রপ্তানি হয়ে আসছে।

মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর পারে পাড়াগ্রাম নামে আশ্চর্য সুন্দর এক গ্রাম আছে। বিরাট গ্রাম। সেখানকার বাজারটাও বিরাট। গুগলে খুঁজলে বলে পাড়াগ্রাম কৃষক বাজার। সরাসরি গেলে দেখা যায় দোকানের নামফলকে ঠিকানা লেখা: ছেরু মিয়ার হাট। ২২ সেপ্টেম্বরে সেই বাজার কাম হাটে গিয়ে দেখা গেল চার-পাঁচ ঝাঁপি ইলিশ উঠেছে বটে, তবে কোনোটারই ওজন ৫০০/৬০০ গ্রামের বেশি না। হাতে ধরে টিপে দেখি, পাকা তালের মতো নরম। আঙুল বসে যায়। হাতির দাম নাকি মরলেও লাখ টাকা। সাইজ যা-ই হোক, পচে নরম হলেও ইহা রাজকীয় মাছ ইলিশই তো! দাম তো হবেই। কিন্তু দাম যে বেজায় বেশি! দামের কারণে যদি বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় মাছ ইলিশ খেতে না-ই পারে, তাহলে ইলিশ থুয়ে পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড রুইকেই জাতীয় মাছ করা হোক।

ভারতে এবার পূজার মৌসুমে ইলিশ রপ্তানির প্রথম অনুমতি দেওয়া হয় ২০ সেপ্টেম্বর। প্রথম দফায় ২০৮০ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি করার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ। ঠিক এর তিন দিন পরই আবারও বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরের দফায় আরও আড়াই হাজার টন ইলিশ রপ্তানির দ্বার খোলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই গানের ভাষাই সত্য হলো। বাংলাদেশের ইলিশ দিয়ে কিছু ভারতবাসীর প্রাণ ভরাতে তৃষা মেটাতে গিয়ে দেশে ইলিশের দাম চড়ে চড়কগাছে উঠল। ডেইলি স্টার লিখেছে, ‘ভারতের কাছে প্রতি কেজি ইলিশ ১০ ডলার বা প্রায় ৮৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দাম বাংলাদেশের পাইকারি বাজারের তুলনায়ও অনেক কম। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরের মহিপুর মৎস্যবন্দর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায়, সেখানে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে (ডেইলি স্টার, অনলাইন, ২৬ সেপ্টেম্বর)।

দেশে ইলিশের একটি বড় উৎস এই মহিপুর মৎস্যবন্দরেই যদি এই দাম হয়, অন্য জায়গায় কী অবস্থা? গত বুধবার থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু হওয়ার পর পাইকারি বাজারে ইলিশের দাম মণ প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে বাড়া (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর) কি কোনো ভালো কথা? যদি পূজা উপলক্ষেই বাংলাদেশের এই ত্যাগ কিংবা উদারতা হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয়, বাংলাদেশে কি পূজা হয় না? এখানেও কি কোটির বেশি সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ নেই? তাঁদের প্রতি কি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব নেই? গ্রামের গরিব হিন্দুরা কি এই দামে পূজার বাজার থেকে ইলিশ কিনতে পারছেন, না পারবেন?

অথচ আমাদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এই জানুয়ারি মাসেই বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘যেভাবে উৎপাদন বেড়েছে, তারপরেও দেশের সব মানুষ ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না। আমার মনে হয় আগে দেশের সব মানুষের কাছে ইলিশ পৌঁছাতে চাই আমরা, তারপর রপ্তানির কথা ভাবা যাবে।’ পাঁচ বছর দূরে থাক, মাত্র আট মাসেই সরকারের অবস্থান বদলে গেল? ৫০০ মেট্রিক টনের জায়গায় নয় গুণের বেশি, ৪ হাজার ৬০০ টন ইলিশ রপ্তানি করতে হলো?

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা আছে বটে, কিন্তু তা সত্যের কান দূরস্থান পা ঘেঁষেও যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘দুর্গাপূজার সময় প্রতিবছরই ভারতে ইলিশ যায়। এটি তারই অংশ। এবার গতবারের তুলনায় ইলিশ বেশি ধরা পড়েছে, সে জন্য রপ্তানি বাড়ানো হচ্ছে।’ গতবারের চেয়ে ইলিশ বেশি ধরা পড়ার তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? মৌসুম এখনো আর সপ্তাহখানেক মাত্র আছে। তারপরেই শুরু হবে জলের এই রুপালি শস্য ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। তার আগে প্রথম আলোর সংবাদ বলছে, এবার ইলিশ ধরা পড়েছে কম। জেলেরা মাছ কম পাচ্ছেন, মাছ গবেষকেরাও বলছেন এবার ইলিশ কম, সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তাঁদের মাত্রাছাড়া সিদ্ধান্তের সাফাই গাইতে গিয়ে এমন তথ্য-পরিসংখ্যানহীন মতামত দিলেন!

ইলিশ রপ্তানির অন্য বাজে দিকটাও মনে হয় খেয়াল রাখা হচ্ছে না। ইলিশ রপ্তানি করে কত আয়ই-বা হবে? কারণ, এটা অঢেল নয়। দ্বিতীয়ত, এই সীমিত সম্পদে রপ্তানির টান লাগলে আরও বেশি বেশি ইলিশ ধরা হবে, জাটকাও বাদ যাবে না। তাতে করে বাধা পড়বে ইলিশের প্রজননে। দীর্ঘ মেয়াদে তা বাংলাদেশকে ইলিশশূন্য করতে পারে। তাই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর কথাকেই নীতি হিসেবে নেওয়া উচিত যে আগামী পাঁচ বছর ইলিশ যেন রপ্তানি করা না হয়। আর তা হলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে। সেই ইলিশ-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ থেকে প্রতিবেশীর জন্য ইলিশ পাঠানোয় তখন আর কার্পণ্য করতে হবে না।

তা ছাড়া ভারতে কম দামে রপ্তানি বাবদ দেশের মানুষকে যখন বেশি দামে ইলিশ কিনতে হয়, তখন তার মনের মধ্যে বঞ্চনার ঘণ্টাটা বেজে ওঠে। ভারত তো নিজের স্বার্থে রপ্তানি বন্ধ করতে কখনো পিছপা হয় না। তা পেঁয়াজ, গরু আসা ঠেকিয়ে দেওয়া কিংবা অগ্রিম দাম পরিশোধের পরও টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া— যাই হোক না কেন। নিজে না খেয়ে অপরকে খাওয়ানোর এই মহানুভবতার সামর্থ্য কি বাংলাদেশ রাখে?

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]

লেখাটি প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত।। 

Bootstrap Image Preview