কাবুলের মার্কেটের এক দোকানে আরেফের ব্যবসা এখন রমরমা। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে তার দোকানের দেয়ালে নীল রঙয়ের পর্দা টাঙানো আছে। ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে ওগুলো আসলে হুকে ঝোলানো অসংখ্য নীল বোরকা।
তালেবান যখন কাবুলের উপকণ্ঠে, শহরের নারীরা তখন নিজেদের প্রস্তুত করছেন আগামী দিনগুলোর জন্য। আরেফ জানান, ‘আগে অধিকাংশ ক্রেতা আসতেন শহরের বাইরের প্রদেশগুলো থেকে। আর এখন শহরের নারীরাই কিনছেন বোরকা।’
এদেরই একজন আলিয়া, দ্রুত চড়তে থাকা বোরকার দাম নিয়ে দোকানির সঙ্গে কথা বলছিলেন।
তিনি বলেন, ‘গত বছরও বোরকার দাম ছিল ২০০ আফগানি (প্রায় ২১৫ টাকা)। আর এখন তারা এগুলোর দাম চাচ্ছে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার আফগানি।’
কাবুলের নারীদের ভীতির সঙ্গে বেড়ে চলেছে বোরকার দামও।
বহু দশক ধরে আফগান নারীদের পরিচায়ক ছিল ঐতিহ্যবাহী আফগানি বোরকা, যেটা অধিকাংশ সময়েই নীলচে রঙের। ভারী কাপড়ে বানানো এই বোরকার নকশা এমন, যাতে যিনি পরবেন তার মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ঢেকে থাকে।
চোখের কাছে ঢাকা থাকে জালের মতো এক ধরনের কাপড়ে, যাতে ভেতরে যিনি আছেন তিনি বাইরে দেখতে পারেন, তবে বাইরের কেউ যেন ভেতরে দেখতে না পারে।
১৯৯০-এর দশকে তালেবান সরকার এ ধরনের বোরকা পরে মেয়েদের বাইরে বের হওয়ার নির্দেশনা জারি করে। নইলে তালেবানের ‘মোরাল পুলিশ’ এর হাতে জনসম্মুখে বেত্রাঘাতের মতো নির্মম শাস্তি পেতে হতো।
২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর অনেকেই ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত কারণে বোরকা পরা অব্যাহত রাখলেও দেশের লাখ লাখ নারী এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। এসব নারী ঘোষণা করেন, তারা কী পরবেন সেটা নিজেরাই ঠিক করবেন।
বর্তমানে কাবুলের রাস্তায় বোরকা পরিহিতদের পাশাপাশি বিভিন্ন স্টাইলের পোশাক পরা নারীদেরও চোখে পড়ে। দেশটির বিভিন্ন আঞ্চলিক ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রঙবেরঙের ছাপা ও নকশা সমৃদ্ধ পোশাকও পরছেন অনেকে।
ফ্যাশন ফটোগ্রাফার ও শিল্পী ফাতিমাহ বলেন, ‘গোটা বিশ্বে প্রাকৃতিকভাবে স্টাইলিস্ট নারীদের অন্যতম হচ্ছেন আফগান নারীরা। কাবুলের রাস্তায় বের হলে আপনি দেখবেন ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কাপড় ও শতাব্দী পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া ও অনুপ্রেরণা। ভবিষ্যতের আশায় থাকা এক সুন্দর ও সৃষ্টিশীল স্পিরিট এটি।’
আর এখন তালেবানের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির কারণে বোরকাগুলো ধুলোময় স্টোররুম ও কাপবোর্ড থেকে বের করে আনছেন বয়স্ক নারীরা, যাদের কট্টোর গোষ্ঠীটির অধীনে জীবন কাটানোর স্মৃতি আছে।
গত সপ্তাহে হেরাত শহরে যখন তালেবান জড়ো হয়, তখন ৬০ বছরের ফওজিয়ার মতো বয়োজ্যেষ্ঠরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন পরিবারের তরুণীদের জন্য বোরকার মজুদ বাড়াতে।
দুই দশক আগে তালেবানের অধীনে বাস করার বাস্তবতা এখনও মনে আছে ফওজিয়ার।
তিনি বলেন, ‘আমরা বয়স্করা সবাই বলছিলাম, নারীদের জন্য পুরনো দিনগুলো কতোটা কঠিন ছিল। আমি কাবুলে থাকতাম। আমার মনে আছে যে সব মেয়ে বোরকা ছাড়া বের হতো তাদেরকে কীভাবে পেটানো হতো।’
তরুণী মরিয়ামকে তার স্বামী জোর করে বোরকা কিনতে পাঠিয়েছেন। পরিস্থিতি মেনে নিতে নাখোশ মরিয়াম বলেন, ‘আমার স্বামী আমাকে বললেন, যে ধরনের পোশাক পরি সেটা পাল্টে বোরকা পরা শুরু করতে। যাতে বাইরে বের হলে তালেবানের নজর আমার দিকে খুব একটা না পড়ে।’
বৃহস্পতিবার হেরাত শহরের পতনের পর মরিয়াম ও ফওজিয়ার মতো নারীদের তালেবানের অধীনেই থাকতে হচ্ছে। শহরের পতনের কিছুক্ষণ পরই হেরাতের নাগরিকদের জন্য তালেবানের পক্ষ থেকে বিলি করা নির্দেশনামায় বলা হয়, জনসম্মুখে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক।
কাবুলে বিষাদের পাশাপাশি বাড়ছে আতঙ্কও। শহরটির দুই-তৃতীয়াংশ নারীর বয়স ৩০ এর নীচে। তাদের তালেবান শাসনের অধীনে বাস করার অভিজ্ঞতা নেই।
কয়েকটি বাড়িতে বোরকার কারণে দুই প্রজন্মের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে গেছে। ২৬ বছর বয়সী হাবিবা ও তার বোনদের শহরে তালেবান আসার আগেই বোরকা পরার অনুরোধ করেছেন তার বাবা-মা, কিন্তু তারা এতে রাজি নন।
হাবিবা বলেন, ‘আমার মা সবসময় বলেন যে, আমাদের বোরকা কেনা উচিত। আমাদের বাবা-মা তালেবানকে ভয় পান। আমার মার মতে, তার মেয়েদের রক্ষা করার অন্যতম উপায় হচ্ছে তাদের বোরকা পরিয়ে রাখা।
‘কিন্তু বাসায় আমাদের কোনো বোরকা নেই, আমার কেনার ইচ্ছাও নেই। আমি পর্দার মতো একটা কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে চাই না। বোরকা পরার অর্থ তালেবান সরকারকে মেনে নেয়া। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার তাদের দিয়ে দেয়া। চাদর পরে থাকা নিজ বাসায় কারাবন্দি হয়ে থাকার প্রথম পদক্ষেপ। আমি এতো কষ্ট করে যা অর্জন করেছি সেগুলো হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আছি।’
হাবিবা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যার সারাজীবন পড়ে রয়েছে। তালেবান তাদের অধীকৃত অঞ্চলে নারীদের সঙ্গে কী করছে সেটার কিছু কিছু খবর বাইরে আসছে। তারা নারীদের বাইরে ঘোরাফেরা সীমিত করে দিয়েছে ও জনসম্মুক্ষে যাদের জীবনযাপন ছিল তাদেরকে খুঁজে বের করছে।
হাবিবা আরও জানান, তার মতো কাবুলের অনেক নারীই সামনে কী আছে সেটা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। কখনও কখনও ২টা-৩টা পর্যন্ত চিন্তা করি কী হবে। আমি ভয় পাচ্ছি, কারণ আমি বোরকাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। শিগগিরই আমাকে বাসায় থাকতে হবে ও স্বাধীনতা হারাতে হবে। আমি যদি বোরকাকে মেনে নেই তাহলে এর ক্ষমতা আমাকে দখল করে নেবে। আমি সেটা করতে দিতে প্রস্তুত নই।’
কাবুলের অনেক তরুণীই হতাশা ও প্রতিবাদের এমন এক টানাপড়েন অনুভব করছেন। মডেল ও ডিজাইনার আমুল বহু বছরের প্রচেষ্টার পর নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন, এখন তিনি বুঝতে পারছেন সেই ব্যবসা ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমার পুরো জীবনের চেষ্টা ছিল আফগান নারীদের সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য ও সৃষ্টিশীলতা তুলে ধরা।’
নীল রঙের বোরকায় ঢেকে থাকা আফগান নারীর চেহারাহীন প্রতিচ্ছবির বিপক্ষে সারাজীবন তিনি লড়াই করেছেন। আমুল বলেন, ‘কখনও ভাবিনি যে, আমাকেও পরতে হবে, কিন্তু এখন আমি জানি না। মনে হচ্ছে আমার পরিচয়কে ঘষে উঠিয়ে ফেলা হচ্ছে।’
সূত্রঃ নিউজবাংলা।
(কাবুলের নারীদের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। পাঠকদের জন্য সেটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।)