Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৪ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ভয়াবহ পদ্মায় কেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না পিনাক-৬?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ আগস্ট ২০২১, ০২:৫২ PM
আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২১, ০২:৫২ PM

bdmorning Image Preview


আজ ৪ আগস্ট, পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের এই দিনে কাওড়াকান্দি-মাওয়া নৌরুটে মাঝপদ্মায় কমপক্ষে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি। সে সময় ঈদের ছুটি শেষে রাজধানী ঢাকায় ফিরছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। অতিরিক্তি যাত্রী নেয়ার কারণে লঞ্চটি ডুবে প্রাণ যায় বহু মানুষের। আজও পিনাক ট্র্যাজেডির কথা মনে পড়লে আতকে ওঠে মানুষ।

সরকারি হিসাবে ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও বেসরকারিভাবে ৮৬ যাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানানো হয়। সাঁতরে ও অন্যদের সহযোগিতায় জীবিত উদ্ধার হয় অনেককে। নিখোঁজ হন আরও ৫০ জন, যাদের খোঁজ আজও মেলেনি। এর মধ্যে আবার অজ্ঞাতনামা হিসেবে ২৮ মরদেহের ঠাঁই হয় শিবচর পৌর কবরস্থানে।

জানা যায়, ২০১৪ সালের ওই সময়টা ছিল ঈদের ছুটি। প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যান অনেকে। আবার ঈদ শেষে যে যার কর্মস্থলে ফিরে যান। কিন্তু ওই বছর আর ফেরা হয় না অনেকের। লঞ্চডুবিতে ঝরে যায় অনেক প্রাণ। এ কারণে ঈদ আসলেই পিনাক ডুবিতে নিহতদের স্বজনদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। হারানো বেদনা নতুন করে ব্যথা বাড়িয়ে দেয় ক্ষতকে। বছরের এই সময়টায় স্বজন হারানো শিবচরের ১২ থেকে ১৪টি পরিবারে নতুন করে জেগে ওঠে স্বজন হারানোর বেদনা।

কোনও হদিস মেলেনি পিনাক-৬ এরঃ  লঞ্চ দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পরে অত্যাধুনিক সোনার স্ক্যানার যন্ত্রের সাহায্যে খোঁজ করে ব্যর্থ হওয়ার পর আর কোনও অনুসন্ধান চালায়নি অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সে সময় আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ জরিপ-১০, কাণ্ডরি-২, সন্ধানী, তিস্তা এখনো সন্ধান পায়নি মাওয়ায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ পিনাক-৬ এর।

 

স্থানীয়দের ধারণা, লঞ্চটি উল্টে গিয়ে পদ্মার তীব্র স্রোতের তোড়ে অনেক দূরে ভাটিতে চলে গেছে। এক সময় বালুর আস্তরণ পড়ে পদ্মার বুকেই বালুর নিচে চাপা পড়েছে।

লঞ্চ উদ্ধারের ব্যাপারে সর্বশেষ নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, লঞ্চ উদ্ধার করা বড় কথা ছিল না। বড় কথা ছিল নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া। লাশ উদ্ধার করা হলেও তা শনাক্ত করা যায়নি। উদ্ধার কাজ করতে অনেক সময় চলে গেছে তাই উদ্ধার তৎপরতা বাতিল করে দিয়েছি। 

লতা-পাতায় ঢেকে গেছে বেওয়ারিশ কবরগুলোঃ পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনায় লাশ উদ্ধার হওয়ার পর নিয়ে আসা হতো শিবচরের পাঁচ্চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেখানে দাফন করা হয়েছে নাম-পরিচয়হীনদের, সেই শিবচর পৌর কবরস্থানেও এখন আসে না স্বজন হারানো কেউ। পঁচা-গলা অসংখ্য লাশ রাখার কারণে বেশ কয়েক মাস বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পেত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে নতুন করে রঙ করা ও স্কুলটি মেরামত করার পর সেই লাশ রাখার স্মৃতি এখন শিক্ষার্থীদের তাড়া করে না। বিদ্যালয়টি চলছে স্বাভাবিকভাবে।

পিনাক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া কয়েকটি লাশ ছাড়াও শিবচর পৌর কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ২১ জন মানুষ। অযত্ন অবহেলায় তাদের কবরগুলো এখন ঢেকে গেছে লতা-পাতার জঙ্গলে। কারও বাবা, কারো মা আবার কারও ভাই-বোন ও স্বজনের লাশ যে এখানে, তা তারা হয়তো জানতেও পারবে না কোনদিন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, লতা-পাতার জঙ্গলে ঢেকে গেছে কবরগুলো। হঠাৎ করে বোঝার উপায় নেই এখানে কোনও কবর রয়েছে। সাংবাদিকদের দেখতে পেয়ে পৌর কবরস্থানের তত্ত্বাবধায় এসে একটি কবরের লতা-পাতা পরিস্কার করে বাঁশের চটি দিয়ে বেড়া দেওয়া কবরের সঙ্গে লাগানো একটি সাইনবোর্ড বের করেন। সেখানে লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতের কবর এবং একটি কবরের নম্বর লেখা দেখতে পাওয়া যায়।

শিবচর পৌর কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক জানান, এই কবরগুলো পদ্মায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের যাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। বেওয়ারিশ লাশের খোঁজে এখানে কেউ আসেনি। চারপাশ থেকে লতাপাতা ঘিরে রেখেছে কবরগুলোকে। আরো আগেই পরিষ্কার করা দরকার ছিল। এক দিনের মধ্যে না পারলেও দুতিন দিনেই সব লতা-পাতা পরিস্কার করে রাখা হবে। কবরের যে পরিচর্যাটুকু পরিবারের লোকজন করেন, আমরা তাই করবো।

বেওয়ারিশ লাশের প্রসঙ্গে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, অজ্ঞাত পরিচয়ে শিবচর পৌর কবরস্থানে দাফন করা ২১টি মরদেহের মধ্যে ৩টির ডিএনএ টেস্ট মিল পাওয়ায়ওইসব  পরিবারকে লাশের কবর শনাক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আসা ভাগ্যবান কয়েকজনঃ  ২০১৪ সালে ঈদ শেষে ঢাকা ফেরার সময় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই থাকায় ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চটি। পাশের একাধিক লঞ্চের উৎসুক যাত্রীদের মোবাইল ফোনে তোলা ভিডিওতে সেই দৃশ্যের পুরোটাই ধরা পড়ে। যারা দেখেছেন তারাও আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন। 

এদিকে লঞ্চ দুর্ঘটনায় উদ্ধার হওয়াদেরও এখনও তাড়া করে ফেড়ে সেই দুর্ঘটনায় ভয়াবহ স্মৃতি। অন্ধকার রাতে উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকার কথা এখনও তারা ভুলতে পারেনি।

লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন মাদারীপুরের শিবচরের বাখরেরকান্দি গ্রামের নূরুল আমিনের ৮ বছর বয়সী ছেলে সাঈদ ও ১৫ বছর বয়সী মেয়ে সাবিনা।

সাঈদ জানায়, ‘লঞ্চ যখন দুলছিল তখন আমরা উপরে (ছাদে) উঠি। লঞ্চ যখন ডুইব্যা যায় তখন আমরা নদীতে লাফ দেই। হেরপর হাতার (সাঁতার) দিয়ে কিছু দূর যাই। কত দূর গেলে সিবোটওয়ালা আইয়া আমারে উডাইছে। ঘাটে নিয়া আমারে একটা চিপস খাইতে দিছে। এরপর দেখি আমার বোন ঘাটে। আমি তখন তাগো কইছি ওই যে আমার বোন। এরপর আমারে বাড়িতে নিয়া আইছে।’

অপর উদ্ধার হওয়া শিবচরের ১৩ বছর বয়সী সাবিনা। সে তার মামাকে নিয়ে বেঁচে থাকলেও তার ছোট এক বোন ও বড় এক বোনকে হারিয়েছে পদ্মায়। উদ্ধার হওয়ার কথা বলতে গিয়ে সাবিনা  জানায়, ওপরে লঞ্চের জানলার কাছে ছিলাম। আমার বইনে ভেতরে ছিল। আমাগো ভিতরে নিয়ে আসে। এরপর পর পর দুইডা ঢেউ আইয়া লঞ্চটা উল্টাইয়া গেল। লঞ্চের তলে পইরা গেছিলাম। একবার ডুব দিয়ে দেখি মাথা নিছে, আবারও ডুবি দিছি দেহি মাথা দরজার সামনে তখন গুতা খাইছি। বাইরাইয়া একটা ড্রাম পাইছি। দেহি অনেক লোক ড্রাম ধইরা রইছে। ধাক্কাইয়া আমিও ড্রাম ধরছি। আমার থেইক্যা ১৫ হাত দূরে দেহি আমার মামা, ড্রাম নিয়া তারেও উদ্ধার করছি। তারপর কিছু সময় ঢেউয়ের মইধ্যে ছিলাম। অনেক পরে একটা স্পিডবোট আইয়া আমাগো উদ্ধার করছে।

দুর্ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বাপ্পী জানান, তার সঙ্গে ছিল তার চাচা ও চাচাতো বোন হীরা, স্বর্ণা ও খালাতো বোন লাকী। ঢেউ দেখে তার বোন হীরা বলেছিল তার ভয় লাগছে। তখন তাকে অভয় দিয়ে বাপ্পী জানান, এই পথে আগে কোনদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাই কোনও চিন্তা নাই। হঠাৎ করে লঞ্চ কাৎ হয়ে ডুবে যাওয়ায় এক হাত দিয়ে হীরাকে ধরে সাতরানোর চেষ্টা করছিলেন। এ সময় একটি ছোট শিশু তার ঘাড়ের উপর এসে জড়িয়ে ধরে। নিজেকে সামলাতে না পেরে শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সে। এ সময় হীরাও তার হাত থেকে ছুটে যায়। এক পর্যায়ে নিজেও অচেতন হয়ে পড়েন। এক সময় টের পায় স্পিডডবোট থেকে তার জামার কলার ও জিন্স প্যান্টের পেছন দিকে বেল্টসহ হাত দিয়ে ধরে কে জেনে টেনে তাকে পানি থেকে তুললো। এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর থেকে সেই শিশুটির কথা তার আজও মনে পড়ে।

এ দুর্ঘটনার পরপরই মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা ও মেরিন কোর্টে ২ টি মামলা হয়। আসামিরা গ্রেফতার হলেও বর্তমানে আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। তবে ৭ বছর অতিবাহিত হলেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পিনাক ৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার পর থেকে এ নৌরুটে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারী রাখা হচ্ছে। কোনভাবেই লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ আইন অমান্য করলে সাথে সাথে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

Bootstrap Image Preview