দেশে এখন ঘরে ঘরে করোনা রোগী। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই অদৃশ্য ভাইরাস। দেশে করোনা রোগীদের শতভাগই ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবি’র ভাইরোলজি ল্যাবরেটরির প্রধান জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মোস্তাফিজুর রহমান। দেশে করোনা ভাইরাসের ডেলটা (ভারতীয়) ভ্যারিয়েন্ট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
এদিকে মাস দুয়েক আগে আশার আলো দেখিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। বলেছিলেন, করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টেই বিপদের শেষ। এর পরে ক্ষমতা কমতে শুরু করবে ভাইরাসের। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। তাদের দাবি, ডেলটা আসলে বিশ্বের উদ্দেশ্যে এক ‘সতর্কবার্তা’। এর পরে মিউটেশন ঘটিয়ে আরো ভয়ানক স্ট্রেইন তৈরি করতে সক্ষম করোনা ভাইরাস। ইতিমধ্যে ১৩২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। আমেরিকায় নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। পশ্চিম এশিয়ায় চতুর্থ ঢেউ আছড়ে পড়ার অন্যতম কারণ ডেলটা। চীনে নতুন করে সংক্রমণ বেড়েছে। আরো দুটি প্রদেশ থেকে সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর মিলেছে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বড় শহর ব্রিসবেন ও কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের একাংশে লকডাউন জারি করা হয়েছে।
আরো ভয়ানক ভ্যারিয়েন্ট আসছে: হু
বিজ্ঞানীরা বলছেন, চিকেন পক্সের মতো ছোঁয়াচে ডেলটা স্ট্রেইনটি। একজন থেকে ৮-৯ জনের শরীরে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। অতিসংক্রামক এই স্ট্রেইনটি সম্পর্কে হু-র জরুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান মাইকেল রায়ান বলেন, ‘ডেলটা হচ্ছে আসলে একটা সতর্কবার্তা। সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া যে, ভাইরাস তার ভোল বদলাচ্ছে এবং এটাও মনে করিয়ে দেওয়া যে, আরো ভয়ানক ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে।’ হু প্রধান টেট্রস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাস বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত চারটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভাইরাসটি যত ছড়াবে, এরকম উদ্বেগ করার মতো ভ্যারিয়েন্ট আরো তৈরি হবে।’
গোটা বিশ্বকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে পর্যালোচনা চালায় হু। এর মধ্যে পাঁচটিতেই গত এক মাসে সংক্রমণ বেড়েছে ৮০ শতাংশ। রায়ানের বক্তব্য, ডেলটার প্রকোপে বেশ নড়বড়ে অবস্থা হয়েছে কিছু দেশের। কিন্তু তাতেও তারা যথেষ্ট সতর্ক করতে পারেনি বাসিন্দাদের। সংক্রমণ রুখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এখনো ব্যর্থ বেশ কিছু দেশ। পারস্পরিক দূরত্ব-বিধি মানা হচ্ছে না। লোকজন মাস্ক পরছেন না। স্যানিটাইজার ব্যবহার করছে না। রায়ানের কথায়, ‘টিকাকরণে কাজ দিচ্ছে। টিকা নেওয়া থাকলে বাড়াবাড়ি কম হচ্ছে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, ভাইরাস একটা ফিল্টার পেয়ে গেছে। সংক্রমণের গতি আরো বাড়িয়েছে ভাইরাস। তাই আগের থেকে আরো গতি বাড়াতে হবে টিকাকরণের।’
এদিকে বিশ্বে টিকার সমবণ্টনের ওপরে বারবার জোর দিচ্ছে জাতিসংঘ। কিন্তু তা হচ্ছে না, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। বিশ্বে এ পর্যন্ত কোভিড টিকার ৪০০ কোটি ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এর বেশিটাই গিয়েছে ধনীদের ঘরে। বিশ্বব্যাংকের হিসেব বলছে, উচ্চ-আয়সম্পন্ন দেশগুলোতে ১০০ জনের মধ্যে ৯৮টি ডোজ বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে ২৯টি দরিদ্র (কম-আয়) দেশে এই হার-প্রতি ১০০ জনে ১.৬ ডোজ। এই পরিস্থিতিতে হু-র আবেদন, সেপ্টেম্বর মাস শেষ হওয়ার মধ্যে সব দেশকে অন্তত ১০ শতাংশ বাসিন্দার টিকাকরণ শেষ করতে হবে। ২০২২ সালের মাঝামাঝির মধ্যে ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
দেশে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার যেভাবে
দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, দেশে করোনার ডেলটা (ভারতীয়) ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত বিস্তারের আশঙ্কা অনেক দিন ধরেই ছিল। সে আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিয়েছে এখন। শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথমে রোগী চিহ্নিত এবং এই ভ্যারিয়েন্টে এক জন মারা গেলে দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ভারতের সঙ্গে সীমান্তসহ সব যোগাযোগ বন্ধ করার দাবি উঠেছিল। সময় উপযোগী এই দাবি মেনে সরকার বিমানবন্দর, পরে নৌ ও স্থলবন্দর বন্ধ রাখে। কিন্তু এই বন্ধ রাখাটা ছিল ঢিলেঢালা। ভারতের সীমান্তঘেঁষা জেলাগুলোর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা একেবারেই কম এবং রোগী ব্যবস্থাপনাও কম থাকার কারণে এসব জেলায় করোনার ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে ছড়ায়। সেখান থেকে সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়েছে। শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় শতভাগ লকডাউন বাস্তবায়ন হলে দেশের বর্তমান এই পরিস্থিতি হতো না। ভারত থেকে যারা এসেছিল তাদের আইসোলেশনেও রাখা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ভারতীয় সীমান্ত অনেকটা অরক্ষিত। দিনে-রাতে অনেকে অবৈধ পথে ভারতে আসা-যাওয়া করে। এ কারণে দ্রুত ছড়িয়েছে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট।
৬ দিনে ১ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে
এই গাফিলতির কারণে করোনার রোগী এত বেশি হয়েছে যে সরকারি হাসপাতালে বেড খালি নেই। ঢাকার বাইরের জেলা-উপজেলায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকট প্রকট। গ্রামে চিকিত্সা ব্যবস্থা নেই। সেখানে চিকিত্সা সেবা না পেয়ে রোগীরা ছুটছেন রাজধানীতে। ঢাকার সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে রোগীরা যাচ্ছেন বেসরকারি হাপসাতালে। এক্ষেত্রে চিকিত্সাসেবা চালাতে গিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
এদিকে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই রবিবার থেকে গার্মেন্টসসহ সব কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে শনিবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঢাকায় আসতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে শ্রমিকরা এসেছেন। এতে সংক্রমণ আরো বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ক্ষিপ্র গতির ভাইরাস। আমাদের আরো স্বাস্থ্যসচেতন হওয়া জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক। এ জন্য যা যা করার তাই করতে হবে। দেশের করোনার ভাইরাসের যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে সামনে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু পরামর্শ দিতে পারে। তিনি বলেন, ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়ায়। লকডাউনটা আরো ভালোভাবে কার্যকর হলে এবং এটা চলমান থাকলে সুফল পাওয়া যেত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং কোভিড গাইডলাইন ও হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ বলেন, জীবিকার তাগিদে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে মানুষের যে ছোটাছুটি তাতে সামনে দেশকে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হতে পারে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের আচরণের সঙ্গে এ দেশের মানুষের আচরণের মিল রয়েছে। এই অবস্থায় সব ওপেন করে দিলে দেখা যাক কী হয়। জীবিকা আগে, নাকি জীবন আগে—তখন বোঝা যাবে। আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে শনিবার ঢাকামুখী মানুষের চিত্র তা দেখিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তৃণমূল নেতাদের নিয়ে গ্রাম পর্যন্ত করোনা রোগীদের আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের সংক্রমিত করতে না পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে যখন ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের রোগী শনাক্ত হয়, তখন বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যে কারণে সারা দেশে ছড়িয়েছে ডেলটা। গার্মেন্টস কারখানা খুলে দিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত, স্বাস্থ্যবিধিও উপেক্ষিত। তিনি বলেন, লকডাউন কার্যকর হলে এবং আরো কিছু দিন লকডাউন চলমান থাকলে সুফল পাওয়া যেত।