চিকিৎসার অনুমোদন না থাকলেও করোনায় আক্রান্ত সবুজ পিরিসকে (৩০) ভর্তি করা হয়েছিল রাজধানীর উত্তরার শিন-শিন জাপান হাসপাতালে। সংকটাপন্ন এই রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে পাঁচ দিন চিকিৎসা দেওয়াও হয়েছিল। দেওয়া হয় ৮০ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের ইনজেকশনও। সবুজ হঠাৎ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দায়িত্বরত নার্সদের ওপর হামলা করে বসেন। তাঁর হাতে থাকা ফল কাটার ছুরির আঘাতে দুই নার্স ও এক ওয়ার্ড বয় গুরুতর আহত হন। হাসপাতালের কর্মীরাও তাঁর ওপর অমানবিক প্রতিশোধ নেন। তাঁদের হামলায় সবুজ গুরুতর আহত হলে চিকিৎসা না দিয়েই তাঁকে বেঁধে রাখা হয়। পরে পুলিশের সহায়তায় স্বজনরা সবুজকে উদ্ধার করে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৬ জুলাই মারা যান তিনি। এদিকে সবুজের হামলায় আহত মিতু রেখা নামে এক নার্স হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
করোনা সংকটকালে এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জেরে পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে উত্তরা পশ্চিম থানায়। মুমূর্ষু থাকা অবস্থায়ই সবুজের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগে মামলা করে শিন-শিন জাপান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সবুজকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেছেন সবুজের শ্বশুর জ্যোতি কস্তা। স্বজনদের অভিযোগ, বেশি দামের উচ্চমাত্রার ওষুধ প্রয়োগের কারণে সবুজ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন। ভারী বস্তু দিয়ে আঘাতের পর সবুজকে চিকিৎসা না দিয়ে প্রায় ১০ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয়। এতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘুমের ওষুধ না দেওয়ায় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে সবুজ হামলা করেন। তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করছে হাসপাতাল। মানবিক কারণে করোনা সন্দেহভাজন আইসোলেশন আইসিইউ হিসেবে সবুজকে ভর্তি করা হয় বলেও দাবি তাদের। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও ঘটনাটি তদন্ত করবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কভিড হাসপাতাল না হয়েও রোগী ভর্তি, উচ্চমূল্যের ইনজেকশন প্রয়োগ এবং আইসিইউয়ের মধ্যে ফল কাটার ছুরি—এসব ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার পাশাপাশি মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে পুলিশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ড. ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘শিন-শিন জাপান হাসপাতালের ঘটনাটি আমরা জেনেছি। তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
সবুজ পিরিসের শ্বশুর জ্যোতি কস্তা জানান, সবুজের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে। তাঁর বাবা সেন্টু পিরিস বেঁচে নেই। মা ও এক বোন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। স্ত্রী লাবনী, ছেলে রায়েন (৯) ও মেয়ে আরহীকে (৪) নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন সবুজ। বাহরাইনে পাচক পেশায় কাজ করলেও বর্তমানে তিনি কিছু করছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রে স্বজনদের কাছে যাওয়ার প্রক্রিয়া করছিল পরিবারটি।
করোনায় আক্রান্ত হলে গত ১৭ জুলাই সবুজের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি। পরে এক ব্যক্তি করোনার রোগীর জন্য শিন-শিন জাপান হাসপাতালে একটি আইসিইউ আছে বলে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তখনো স্বজনরা জানত না যে শিন-শিন হাসপাতালের করোনা চিকিৎসার অনুমোদন নেই।
জ্যোতি কস্তা আরো বলেন, ‘ভর্তির পর থেকেই দামি ওষুধ দিতে থাকে। একটি ইনজেকশন দেয় ৮০ হাজার ৮০০ টাকার। সব ওষুধ তাদের ফার্মেসি থেকে নিতে হয়। এক লাখ ২৪ হাজার টাকা হাসপাতালে বিল হয়। পাঁচ দিনে খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ঘটনার পর আমরা জানতে পারি, এটি করোনা হাসপাতাল না।’
স্ত্রী লাবনী বলেন, ‘দামি ইনজেকশন দেওয়ার পরই সে কেমন যেন হয়ে যায়। উচ্চমাত্রার ওই ওষুধের প্রভাবে উত্তেজিত হয়ে কিছু করে থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তা পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।’
পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মামলার সূত্রে জানা যায়, গত ২২ জুলাই রাতে ছুরি নিয়ে নার্স মিতু রেখার ওপর আক্রমণ করেন সবুজ। এ সময় আরেক নার্স আফরোজা এগিয়ে গেলে তাঁকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। ওয়ার্ড বয় সাগর ছুটে গিয়ে সবুজকে আটকানোর চেষ্টা করলে সবুজের ছুরির আঘাতে তিনিও আহত হন। এ ঘটনায় দুজন চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেও মিতু সংকটাপন্ন। আইসিইউতে থাকা মিতুকে সাত ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়েছিল।
সবুজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে জ্যোতি কস্তা বলেন, ‘হাসপাতালের লোকজন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে নির্মমভাবে একজন রোগীকে মেরেছে। পরদিন সকালে গিয়ে দেখি সবুজকে আইসিইউয়ের বাইরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। তার পুরো শরীর ফুলে ফোসকা পড়ে আছে। এক হাতের হাড় ভেঙে যায়। অন্য হাতের কনুইয়ের জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে চিকিৎসকরা বলেছেন, তাকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। এতে তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অপারেশন করার পরও ২৬ জুলাই মারা যায়।’
জানতে চাইলে শিন-শিন জাপান হাসপাতালের ব্যবস্থাপক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে কভিডের অনুমতি নেই। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় সন্দেহভাজন রোগীদের আইসোলেশনে রাখতে দুটি আইসিইউ বেড রাখার কথা বলা আছে। এই হিসেবে আমরা রেখেছিলাম। তারা প্রথমে বলেছিল অ্যাজমার কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট। পরে পরীক্ষায় করোনা নিশ্চিত হওয়ার পর রোগী ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যেই ঘটনা ঘটে।’ উচ্চমূল্যের ইনজেকশন ও চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বেশি অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় যা দরকার তা-ই চিকিৎসক দিয়েছেন। রোগীর তো উন্নতি হয়েছে।’
হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ সবুজকে মারেনি। হুড়াহুড়ির মধ্যে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার তার ওপর পড়েছিল। এতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।’
নতুন ছুরির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদেরও প্রশ্ন। আইসিইউতে ফল কাটার ছুরি থাকার কথা নয়, তা-ও আবার নতুন।’
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি শাহ মো. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘হাসপাতালকর্মীদের মারধরের ঘটনায় আগে সবুজের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন সবুজের শ্বশুর তার ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করেছেন। হাসপাতালটির জিএমকে সন্দেহভাজন বলা হলেও এজাহারে আসামি হিসেবে কারো নাম নেই। উভয় পক্ষের হামলার বিষয়টি প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘হাসপাতালটির করোনা চিকিৎসার অনুমোদন ছিল না। চিকিৎসাসংক্রান্ত আর কোনো সমস্যা ছিল কি না, তা দেখা হচ্ছে। ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। এখনো গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি।’
সূত্র; কালের কণ্ঠ