Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে চাপে জাপান

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২১, ০১:৪৪ PM
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২১, ০১:৪৪ PM

bdmorning Image Preview


জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সরকারিভাবে অঙ্গিকার রয়েছে জাপানের। অথচ, দেশটি থেকে প্রায় ৪,০০০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের একটি ম্যানগ্রোভ দ্বীপে জাপানের অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই প্রকল্পই এখন জাপানের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যে দেশটি আসলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে কতটা আন্তরিক। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এমনটা বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে মাতারবাড়ি নামে ওই দ্বীপে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের বয়স ১০ বছর ছাড়িয়েছে। ‘মাতারবাড়ি ফেজ ২’ নামের প্রকল্পটির সম্প্রসারণে অর্থায়নের কথাও ভাবছে জাইকা। অথচ, চলতি বছরের শুরুতে, জাপানের সরকারি সংস্থাটি জানিয়েছিল যে, বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে কার্বন-শূন্য বা জিরো-কার্বন নীতিমালা বাস্তবায়নে কাজ করবে তারা।
মাতারবাড়ি প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক জাপানের জীবাশ্ম-জ্বালানি নীতিমালার বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

দেশে বিদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের জন্য যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, তাতে ব্যাতয় ঘটাতে পারে উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে জীবাশ্ম-জ্বালানি ভিত্তিক প্রকল্পে জাপানের এসব অর্থায়ন।

অপরদিকে বাংলাদেশে—যেটি জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি প্রয়োজন মেটাতে কয়লা ব্যবহারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির খরচ যত কমছে মাতারবাড়ি প্রকল্পের মতো বিশাল কয়লা-ভিত্তিক প্রকল্পগুলো নিয়ে উৎসাহ ততই কমছে। গত মাসে পূর্ব-পরিকল্পিত ১০টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে হাসিনা সরকার। ওই প্রকল্পগুলোর তালিকায় মাতারবাড়ি ফেজ ২-এর নাম না থাকলেও, বিশ্লেষকরা বলছেন ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা ও উপযোগিতা দিনকে দিন কমছে।

মার্কিন থিংক-ট্যাংক ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস বলেন, [বাংলাদেশ] এখন আগের চেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। তাদের কয়লা ব্যবহার থেকে সরে আসতে দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ জানিয়েছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশই নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে চায় তারা।

সেকেলে নীতিমালা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটির বহু অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে আসছে জাপান। কিন্তু মাতারবাড়ি প্রকল্পে অর্থায়ন করার কারণে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে জাইকাকে।

প্রগতিশীল অধিকারকর্মীদের সংগঠন বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট-এর সদস্য হাসান মেহেদি বলেন, অন্যান্য দেশে কয়লা শক্তিতে অর্থায়নের কোনো অধিকার নেই জাপানের। কার্বন নির্গমন শূন্য করার ক্ষেত্রে তাদের একটা দায়িত্ব আছে। অন্যান্য দেশে দূষণ তৈরি করে অর্থ আয় করছে তারা, যাতে নিজেরা পরিষ্কার থাকতে পারে।

অপরদিকে, জাপানের অভ্যন্তরেও সমালোচনা তৈরি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, বাইরের বিভিন্ন দেশে জাপান যেভাবে কয়লা ব্যবহারের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে, তা সেকেলে নীতিমালার অংশ।

বছর কয়েক আগেও অন্যান্য দেশে জাপানের কয়লা-চালিত বয়লার ও টার্বাইন সরবরাহ করাকে দেশের একটি কৌশলগত জাতীয় শিল্পের প্রতি সরকারের সমর্থন দেওয়ার দায়িত্ব হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু এখন অনেকের কাছেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কয়লায় ভবিষ্যৎ নেই। গত বছরে দেশটির এ সংক্রান্ত নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। বিদেশে নতুন কয়লা প্রকল্পে অর্থায়ন সীমিত করে দেয় জাপান সরকার। ব্যাংকগুলোও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচিত হয়ে কয়লায় অর্থায়ন করায় কিছুটা অনাগ্রহ দেখাতে শুরু করে।

ইউনিভার্সিটি অব টোকিও’র অধ্যাপক ও জাপান সরকারের বিদেশে কয়লায় অর্থায়ন সংক্রান্ত প্যানেলের সদস্য ইউকারি তাকামুরা বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কাজ করা জাপানি শিল্পের জন্য খুব একটা সম্ভাবনাময় নয়। প্রায় সব ব্যাংকই এখন বলে দিয়েছে, তারা বিদেশে নতুন কয়লা প্রকল্পে আর অর্থায়ন করবে না।

তবে এখনো বিদেশি কয়লা প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোনো স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি জাপান। এ বিষয়ে তাদের সরকারি নীতিমালা নিয়ে এখনো কিছুটা অস্পষ্টতা থাকলেও গত মাসে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে কয়লায় অর্থায়ন বন্ধ করতে সবচেয়ে জোরদার প্রতিশ্রুতি করেছে দেশটি। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ অনিয়ন্ত্রিত কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব ধরণের সরাসরি সরকারি সমর্থন বন্ধ করতে সম্মত হয় দেশটি। এর ফলে মাতারবাড়ি প্রকল্পের মতো কিছু জ্বালানি প্রকল্প নিয়ে দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, এই প্রকল্পগুলো জাপানের নয়া সরকারি নীতির পরিপন্থী, আবার অপরদিকে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে অতীতে চুক্তি করেছে সরকার।

লাভবান কারা? এদিকে, মাতারবাড়ি প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশিদের মতামত দুই ভাগে বিভক্ত। সমর্থকদের ভাষ্য, এ প্রকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করবে। আবার সমালোচকরা অভিযোগ এনেছেন, প্রকল্পটির বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করছে। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কোহেলিয়া নদী দূষিত করছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের শরিফ জামিল বলেন, স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে যে, ঠিকাদাররা বাইরের শ্রমিক এনে প্রকল্পের কাজ করাচ্ছে। তারা ভেবেছিল এ প্রকল্প এলাকাটিকে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত করে তুলবে। কিন্তু এখন সে ভ্রান্ত ধারণা কেটে গেছে।

আইইইএফএ’র নিকোলাস বলেন, এসব প্রকল্প বাংলাদেশকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ধাবিত করবে। দেশটির বর্তমান বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার মোট উৎপাদনের মাত্র ৪০ শতাংশের মতো।

নিকোলাস মনে করেন, দেশটির উচিৎ তাদের গ্রিড উন্নত করে বিদ্যমান বিদ্যুৎ সরবরাহ আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে থাকা।

তিনি বলেন, কিছুকাল আগেও ভাবা হতো, যেহেতু জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন সামুদ্রিক কয়লা আমদানি থেকে সরে যাচ্ছে, এসব কয়লার প্রধান বাড়ন্ত বাজারগুলোর একটি হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো বর্ধনশীল বাজার কয়লা আমদানির দিক থেকে জাপান, কোরিয়া বা চীনের হারানো বাজারের বিকল্প হয়ে উঠবে না।

(দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনূদিত)

সূত্রঃ মানবজমিন

Bootstrap Image Preview