Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ফেরির তেল চুরি করতে গিয়ে পদ্মা সেতুতে ধাক্কা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২১, ১২:২৩ PM
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২১, ১২:২৩ PM

bdmorning Image Preview


তেল খরচ কমাতে সংক্ষিপ্ত পথে চলতে গিয়ে পদ্মা সেতুতে আঘাত করে রো রো ফেরি শাহজালাল। স্রোতের অনুকূলে কম গতিতে চালাতে (২৫০ আরপিএম) গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয় ফেরিটি। অথচ স্রোতের বিপরীতে কিছুটা উপরের দিকে চালিয়ে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ফাঁক দিয়ে নদী পাড়ি দিলে এ ঘটনা এড়াতে পারতেন ফেরির দুই চালক (মাস্টার ও সুকানি)। সেক্ষেত্রে পথটি দীর্ঘ হতো এবং গতিও বাড়াতে হতো। এতে তেল খরচ হতো বেশি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তেল বাঁচিয়ে তা বাইরে বিক্রি করে দেওয়া। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আরও জানা গেছে, ফেরির আঘাতে সেতুর ১৭ নম্বর পিলারের ক্যাপে কিছুটা স্ক্যাচ পড়েছে। আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবি ফেরিটির বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। ডকইয়ার্ডে নিয়ে মেরামতের আগে এটি চলাচল করতে পারবে না।

এদিকে এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে কৌশল নিয়েছেন ফেরির দুই চালক ও অন্যান্য স্টাফরা। সেতুতে আঘাত দেওয়ার আগে স্টিয়ারিং কাজ করছিল না বলে তদন্ত কমিটির সদস্যদের কাছে দাবি করেন তারা। যদিও তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে স্টিয়ারিং ভালো পাওয়া গেছে। তবে তারা ধীরগতিতে চালানোর কথা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় ফেরির দুই চালককে (মাস্টার ও সুকানি) দায়ী করে প্রতিবেদন দিতে যাচ্ছে তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, ফেরির ইঞ্জিন কম আরপিএমে (কম গতিতে) চালালে তেল খরচ কম হয়। এভাবে ফেরির জন্য বরাদ্দ করা তেল বাঁচিয়ে তা গোপনে বিক্রি করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তেল বিক্রির ওই টাকা ফেরির স্টাফসহ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তার পকেটে যায়। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও তেল আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছিল। এবারের ঘটনায় জমা দিতে যাওয়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তেল বাঁচানোর বিষয়টি উঠে না এলেও কম গতিতে ফেরি চালানোর তথ্য উঠে আসছে। গতি কম ও স্রোত বেশি থাকায় সেতুর কাছে এসে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হারান চালকেরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম শনিবার বলেন, পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির আঘাত দেওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পাইনি। কমিটির প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারব। তিনি বলেন, ওই প্রতিবেদন নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শুক্রবার সকালে পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে রো রো ফেরি শাহজালালের। এ সময় ফেরিতে থাকা যাত্রীরা ছিটকে একে অপরের ওপর পড়ে আহত হন। কমপক্ষে ২০ জন যাত্রী এ সময় মারাত্মক আহত হন। ওই দিনই বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এসএম আশিকুজ্জামানকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ৩ দিনের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। শুক্রবার কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ফেরিতে কর্মরত ছয়জনের বক্তব্য নেন। শনিবার খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেন। আজ বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারের সঙ্গে ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনায় শনিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় সেতু বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক, পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ও সেতু বিভাগের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্্ উদ্দিন চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক, প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আবদুল মতিন, প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. মাহিদুল ইসলামহসহ সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে নৌসচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে চালক সাবধানতা অবলম্বন না করেই ফেরি চালিয়েছেন। এ ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সেতুর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ফেরির আঘাতে পিলারের ক্যাপে স্ক্যাচ পড়েছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তিনি বলেন, সেতুর পিলার চার হাজার টন জাহাজের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতাসম্পন্ন। ফেরির ওজন ছিল মাত্র এক হাজার ২০০ টন। সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতুর প্রতিটি পিলারের সঙ্গে নিরাপত্তামূলকভাবে ঢালাইয়ের ক্যাপ রয়েছে। ফেরিটি ক্যাপে আঘাত করেছে।

এদিকে তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন শুক্রবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে বাংলাবাজার ঘাট থেকে ৩টি বাস, ২টি ট্রাক ও ২৮টি ছোট গাড়ি এবং ৫০০-৬০০ জন যাত্রী নিয়ে শিমুলিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। মাগুড়খণ্ড নামক এলাকা অতিক্রম করার সময়ে নদীর স্রোত ও বাতাসের গতিবেগ লক্ষ্য না করেই স্বাভাবিক গতিতেই পদ্মা সেতুর কাছাকাছি এসে ১৬ ও ১৭নং পিলারের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেওয়ার চেষ্ট করেন চালকরা। ফলে ফেরিটি স্রোতের কারণে আড়াআড়ি হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ সময় ফেরির ইঞ্জিনের গতি ছিল মাত্র ২৫০ আরপিএম। ওই সময়ে স্রোতের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটারের কম।

বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, ফেরি শাহজালালে ৬০০ আরপিএম ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন রয়েছে। ৩০ বছরের পুরানো এ ফেরি ৪০০ থেকে ৪৫০ আরপিএমে চলতে সক্ষম। চলাচলরত অবস্থার জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১২৫ লিটার তেল বরাদ্দ দেওয়া আছে। ঘাটে ভেড়ানো অবস্থায় থাকার সময়ের জন্য তেল বরাদ্দ ৬২ দশমিক ৫ লিটার। নিয়ম অনুযায়ী, কম আরপিএমে চালালে তেল খরচও কম হয়।

তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ফেরির গ্রিজার মো. আজাদ আলী কমিটির সদস্যদের জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার আগে ২৫০ আরপিএমে সামনের দিকে চলছিল ফেরিটি। ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম কমিটিকে জানিয়েছেন, পিলারে ধাক্কা লাগার পর জাহাজটি পেছনে চালানোর সংকেত পান। তখন জাহাজটি ৪০০ আরপিএমে পেছনে নেন। তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, ফেরিটি উজানে আরও অগ্রসর হয়ে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের মাঝ দিয়ে নদী পাড়ি দিলে এ ঘটনা এড়ানো যেত। কিন্তু তেল খরচ কমাতে স্রোতে গা ভাসিয়ে ফেরিটি নদী পাড়ি দিচ্ছিল। এ কারণে ফেরির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন চালকেরা।

দায় এড়ানোর চেষ্টা স্টাফদের : জানা গেছে, ফেরির স্টিয়ারিং কাজ করছে না এমন অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করেন ফেরির স্টাফরা। তদন্ত কমিটিকে দেওয়া জবানবন্দিতে ভারপ্রাপ্ত মাস্টার কর্মকর্তা আ. রহমান খাঁন বলেন, ফেরিটি যখন ১৬ ও ১৭নং পিলারের কাছাকাছি আসার মুহূর্তে দেখতে পান স্টিয়ারিং সিস্টেম কাজ করে না। তিনি আতঙ্কিত হয়ে জলযানটি ব্যাক গিয়ার অর্থাৎ পেছনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পেছনে পানির স্রোত ও বাতাসের কারণে ফেরিটি পদ্মা সেতুর ১৭নং পিলারের কাছে পড়ে যায়। তিনি আরও জানান যে, স্টিয়ারিংয়ের সার্কিট ব্রেকার পুনরায় স্থাপন করে তিনি জলযানটি ঘাটে নিয়ে আসেন। ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিন কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, স্টিয়ারিংয়ের সার্কিট ব্রেকার খারাপ ছিল। তবে সেটি ২০ জুলাই অর্থাৎ ঘটনার ২ দিন পূর্বে নতুনভাবে স্থাপন করা হয়। হুইল সুকানি মো. সাইফুল ইসলাম জবানবন্দিতে জানান, ব্রিজের কাছাকাছি আসার পর সুকান হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। ডানে বামে কাজ করে না।

তবে তদন্ত কমিটি পর্যবেক্ষণ করে স্টিয়ারিং ভালো অবস্থায় পেয়েছেন। কমিটির একজন সদস্য জানান, ঘটনার পরপরই ওই স্টিয়ারিং দিয়েই ফেরিটি চালিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে আনা হয়। ফেরি শাহজালাল জলযানটি সাম্প্রতিক সময়ে ডকিং মেরামত করে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে চালু করা হয়। ফেরিতে কর্মরতরা নিজেদের বাঁচাতে স্টিয়ারিংয়ে ত্রুটির কথা বলেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মাস্টার আ. রহমান খাঁন ও হুইল সুকানি মো. সাইফুল ইসলামকে এ ঘটনায় দায়ী করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বাংলাবাজার ঘাট স্থানান্তর করে মাঝিকান্দি সরিয়ে নেওয়া, পিলারের গায়ে রাবারের ফোল্ডার দেওয়া ও কম গতির ফেরি শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুট থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে।

মাস্টারের ডোপ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা : জানা গেছে, শাহজালাল ফেরির চালক (মাস্টার) আব্দুর রহমান খাঁনকে শনিবার পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। এদিন মাদারীপুর সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে তার ডোপ টেস্ট ও শারীরিক পরীক্ষা করা হয়েছে। তিনি মাদকাসক্ত নয় বলে সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিরাজ হোসেন বলেন, থানায় জিডি হওয়ায় তদন্তের স্বার্থেই আমরা রো রো ফেরি শাহজালালের ইনচার্জ ইনল্যান্ড মাস্টার অফিসার আবদুর রহমানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।

সূত্রঃ যুগান্তর

Bootstrap Image Preview