রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামি’আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার কর্তৃত্ব হারাচ্ছেন আলোচিত হেফাজত নেতা মামুনুল হক ও তার বড় ভাই মাহফুজুল হক। মাদ্রাসাটি ছেড়ে দিয়েছেন মুহতামিম মাহফুজুল হক। সোমবার সকাল ৯টার দিকে অনুসারী শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে মাদ্রাসাটি ছেড়ে যান তিনি। পরে মাদ্রাসার প্রধান ফটকে তালা দেয়া হয়।
মাদ্রাসার চাবি সরকার স্বীকৃত ইসলামি শিক্ষা বোর্ড আল হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে বলে জানান মাহফুজুল। তিনি বলেন, ‘মাহমুদুল হাসান সাহেব অন্যান্য শীর্ষ অলেমদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত একটি কল্যাণকর এবং সুন্দর একটা সমাধান আমাদেরকে দেবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’
মাহফুজুল হকের সঙ্গে অন্য শিক্ষকদেরও মাদ্রাসা ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে জামিয়া রহমানিয়ার শিক্ষক মাওলানা নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আমাদের অধ্যক্ষের অধীনে সেখানে থাকি। কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে উনাকে জিজ্ঞেস করুন।’
জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার আরেক শিক্ষক মাওলানা আনিসুর রহমান বলেন, ‘মাদ্রাসার চাবি হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে। তাহলে তো সবাইকে বের হতে হবে। না হলে তালা মারবে কীভাবে। তাহলে কি শিক্ষকরা ভেতরে আটকা থাকবে?’
এর আগে সকাল পৌনে ৯টার দিকে মাদ্রাসা থেকে ফেসবুক লাইভে আসেন মাহফুজুল হক। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বিভিন্নভাবে কথা আসছে, আমাদের এ প্রতিষ্ঠান ছাড়তে হবে। এ ভবন আমাদের ছাড়তে হবে। আমরা লক্ষ্য করছিলাম। আমাদের কাছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো নোটিশ আসেনি। আমাদের দেশের শীর্ষ আলেমরা এ বিষয়টি নিয়ে কোনো পরামর্শও করছেন না।’
মাহফুজুলের ভাই মামুনুল হক নিজেও এই মাদ্রাসার শিক্ষক। নেতৃত্বে পরিবর্তন আসলেও তাকে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে কি না, সেটি নিশ্চিত করেননি তিনি।
মাহফুজুল হক বলেন, ‘মাওলানা মামুনুল হক এখানকার শিক্ষক। তিনি তো এখন ভেতরে (জেলে)। উনি বাইরে থাকলে বলতে পারলাম। এটা উনার বিষয়, তিনি থাকবেন কী থাকবেন না।’
মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে দেশজুড়ে তাণ্ডব চালায় হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে এপ্রিলের শুরুতে নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে এক নারীসহ স্থানীয়দের হাতে আটক হন মামুনুল। আমিনা তাইয়্যেবা নামে ওই নারীকে মামুনুল তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করলেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে গত ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের ওই মাদ্রাসা থেকে মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর থেকে হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সবাইকে বিভিন্ন সহিংসতার মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে।
নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার থামাতে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। কিন্তু গ্রেপ্তার অভিযান থামছে না।
মামুনুল ও মাহফুজুলের বাবা আজিজুল হক মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর অধ্যক্ষ হয়েই জড়িয়ে পড়েন অনিয়মে, যে কারণে ১৯৯৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও অধ্যক্ষ হওয়ার পর আজিজুল হক সেই নিয়ম ভাঙতে শুরু করেন। রাজনৈতিক সংগঠন খেলাফত মজলিসের আমির হওয়ার সুবাদে বিএনপি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। এরপর নানান অভিযোগে ১৯৯৯ সালে মাদ্রাসা থেকে তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়।
তবে ২০০১ সালের ৩ নভেম্বর স্থানীয় বিএনপি ও পুলিশের সহায়তায় আজিজুল হকের পরিবারের সদস্যরা মাদ্রাসাটি দখল করেন। হামলায় নেতৃত্ব দেন মামুনুল হক ও তার ভাই মাহফুজুল হক। চারদলীয় জোটের এমপি ও আজিজুল হকের এক মেয়ের ভাশুর মুফতি শহীদুল ইসলামও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
মাদ্রাসা দখলের পর এর প্রতিষ্ঠাতা ও সরকার অনুমোদিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিতাড়িত করা হয়। অনুমোদনহীন পারিবারিক কমিটির মাধ্যমে শুরু হয় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।
অন্যদিকে, প্রকৃত পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বিতাড়িত হওয়ার পর মূল মাদ্রাসার কয়েক শ গজ দূরে একই নামে আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন মূল জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত অধ্যক্ষ মাওলানা হিফজুর রহমান। নতুন ওই মাদ্রাসার কার্যক্রম এখনও চলমান।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে আজিজুল হক মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসা দখলের পর আবদুল মালেককে প্রধান করে ৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করেন।
সেই কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করে বিতাড়িত পরিচালনা কমিটি। ঢাকা জেলা জজ আদালতের সেই মামলার (নম্বর ৪১০/২০০১) রায় বিতাড়িত কমিটির বিপক্ষে যায়। আজিজুল হকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে ২০১২ সালে হাইকোর্টও বিতাড়িত কমিটির পক্ষে রায় দেয়। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল ২০১৪ সালে আপিল বিভাগেও খারিজ হয়।
এর মধ্যে ২০১২ সালের আগস্টে আজিজুল হক মারা যান। তবে তার মৃত্যুর পর ছেলেদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসাটি।
আদালতে মামলার মধ্যেই ২০০৩ সালে ওয়াকফ প্রশাসন থেকে নিবন্ধন পেয়ে ২০০৬ সালে ২১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করে মাদ্রাসার বিতাড়িত কমিটি। নতুন কমিটির সভাপতি আহমদ ফজলুর রহমান জমির বৈধ কাগজের ভিত্তিতে আজিজুল হকের অবৈধ কমিটিকে উচ্ছেদ করে তাদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ওয়াকফ প্রশাসনে আবেদন করেন।
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে মাদ্রাসার অবৈধ কমিটিকে উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয় ওয়াকফ প্রশাসন। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দুইবার জেলা প্রশাসন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলেও তারা উচ্ছেদের কোনো পদক্ষেপ নেননি। ওয়াকফ কমিশনের এই আদেশের বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন আজিজুল হক, তবে সেটিও খারিজ হয়।
আইনি এসব লড়াইয়ের বেশ কিছু নথি পেয়েছে । ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মাদ্রাসাটি দখলমুক্ত করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মকবুল হোসেন ও মো. কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের বর্তমান অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেনি নিউজবাংলা, ফলে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।
সূত্রঃ নিউজবাংলা