Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রাজধানী জুড়ে ‘ঈদ সালামির’ জন্য কিশোর গ্যাংয়ের দল বেঁধে মহড়া

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২১, ০৫:৫৫ AM
আপডেট: ১০ মে ২০২১, ০৫:৫৫ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বন্ধ করতে এক-দেড় মাস আগে রাজধানীজুড়ে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। শতাধিক কিশোরকে আটকও করা হয়। কিন্তু অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বরং ঈদুল ফিতর সামনে রেখে তাদের পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক উৎপাত আরো বেড়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কিশোর গ্যাংয়ের দল বেঁধে মহড়া দেওয়ার চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই কিশোর গ্যাং গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের হাতে। মিছিল-সমাবেশকেন্দ্রিক শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে দাপট দেখানো, নীরব চাঁদাবাজির বড় হাতিয়ার এরাই। তারা ঈদ-উৎসবে ‘বড় ভাইদের’ কাছে যায় সালামির আশায়। ‘বড় ভাইয়েরা’ ত্রাণ বা সহায়তা হিসেবে যেখানে যা পান তার বেশির ভাগই ‘ছোট ভাইদের’ তুষ্ট করার জন্য বিলিয়ে দেন।

সম্প্রতি কামরাঙ্গীর চর এলাকার একজন কাউন্সিলর ত্রাণের টাকা নিজের পছন্দের কর্মী ও কিশোর গ্যাং সদস্যদের ‘ঈদ সালামি’ হিসেবে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন।

জানা যায়, ঈদ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এলাকাকেন্দ্রিক ব্যাবসায়িকপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায় করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। আর দলীয় নেতাকর্মী যারা নিয়মিত টাকা দেয় না তাদের কাছ থেকে সদস্যপিছু ১৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। যেসব নেতাকর্মী কিশোর দল নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা তো নিয়মিতই দেন। এ ছাড়া নেতারা খুশি হলে মোবাইল ফোনসেট, মোটরসাইকেলও উপহার হিসেবে পেয়ে যায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

রাজধানীর লালবাগ থানাধীন আমলীগোলা এলাকার পুষ্পসাহা পুকুরপারে ঢাকা দক্ষিণের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি একরাম উল্লাহ সারোয়ার্দীর রাজনৈতিক কার্যালয়। তাঁর কার্যালয় ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, স্থানীয় ছাত্রলীগকর্মী সুজন ওই গ্যাং পরিচালনা করেন। ঈদ ঘিরে তাঁর নেতৃত্বে এলাকার বিভিন্ন দোকান থেকে কিশোর গ্যাং চাঁদা তুলছে বলে একাধিক দোকানি অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়াও এলাকায় নতুন কোনো ভবন তৈরি করতে গেলেও তাদের টাকা দেওয়া লাগে, নয়তো কৌশলে গলিতে ঢুকতে দেওয়া হয় না নির্মাণসামগ্রী।

অভিযোগ অস্বীকার করে একরাম উল্লাহ সারোয়ার্দী বলেন, ‘আমার অফিসে পোলাপান আসে না, মুরব্বিরা আসেন। চাঁদাবাজির অভিযোগও মিথ্যা।’

গত বুধবার রাত ৮টার দিকে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের প্রধান সড়কে আড্ডা দিচ্ছিল ৩০ থেকে ৪০ জন কিশোরের একটি দল। ওই দলের সদস্য রাব্বি (১৪) নামে একজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। রাব্বি জানায়, তারা সাফায়াত উল্লাহ গ্রুপের। তিনি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। ওই এলাকার ঢাকা উদ্যান-৪, নবীননগর এক নম্বর রোড, তুরাগের তীরসহ আশপাশে কিশোর গ্যাং সদস্যদের আনাগোনা সব সময়। এলাকায় রিকশা চুরি, দোকান থেকে পণ্য কিনে টাকা না দিয়ে চলে যাওয়ার মতো অপরাধে জড়িত তারা।

হুমায়ুন নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘নবোদয় হাউজিং, শেখেরটেক, রায়েরবাজার এলাকা থেকে দল বেঁধে কিশোররা এসে ঝামেলা পাকায়।’

গত ৫ মে রাত ৯টার দিকে ঢাকা উদ্যান এক নম্বর সড়কে শাহিন নামে এক কিশোরকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে কিশোরদের আরেকটি দল।

রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের এক নম্বর ফটকের বাঁয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের প্রধান কার্যালয়। বেড়িবাঁধ সড়কের আরেক প্রান্তে পশ্চিম জাফরাবাদ ১ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের কার্যালয়। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ফটক থেকে বছিলা সড়ক পর্যন্ত সড়কের পাশে জাতীয় শ্রমিক লীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কার্যালয়সহ অন্তত তিন ডজন কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয় থেকে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সাহস অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ পরিচয় দেওয়া পদ-পদবিহীন নেতারা তাঁদের পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে। দলের নেতাদের কাছ থেকেও চাঁদা নিতে যায় তারা। যদিও আমাদের পর্যন্ত আসার সাহস পায় না।’

ঢাকা দক্ষিণের মুগদা, সবুজবাগ ও খিলগাঁওয়ে এই সমস্যা আরো বেশি। খিলগাঁওয়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসী জিসানের অনুসারী রাউফুল ইসলাম শুভ নিয়ন্ত্রণ করেন কিশোর গ্যাং। যিনি নিজেকে খিলগাঁও শাখা যুবলীগের একজন সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর অধীনে শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য আছে বলে জানা গেছে।

আজিমপুর নিউ পল্টন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা পরিচয় দেওয়া দ্বীন মোহাম্মদের এক সহযোগী। সেখানে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ রয়েছে।

কামরাঙ্গীর চরের পূর্ব ও পশ্চিম রসুলপুরসহ আশপাশের এলাকাবাসীও অতিষ্ঠ এই কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে। অভিযোগ আছে, কামরাঙ্গীর চর থানা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি পারভেজ হোসেন বিপ্লব এলাকায় ‘ইয়ামিন’ ও ‘ফয়সাল’ নামে দুটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন। পারভেজ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বহিষ্কার হলেও বিভিন্ন জায়গায় আমাকে সভাপতি বলে তারা। এরা কিশোর গ্যাং না। কোনো একটা ঘটনা করে ফেললে, নেতার ছবি থাকলে সেটা শো করে বাঁচতে চায়। সেটা আমি হই আর যেই হোক। এখন ঈদ সবারই তো বাড়তি চাওয়া থাকে।’

জানা যায়, পারভেজ ছাড়াও ১, ২ ও ৩ নম্বর গলি নিয়ন্ত্রণ করেন ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক পরিচয় দেওয়া নাসির হোসেন (২৬) ও তাঁর সহযোগী তুহিন (২২)। তাঁদের নিয়ন্ত্রণে কিংশোর গ্যাংয়ের ৭০ থেকে ৮০ জন সদস্য আছে। এদের আড্ডা পূর্ব রসুলপুর ১ নম্বর গলির মাথায় আওয়ামী লীগ নামধারী নেতা কামালের ‘ক্লাবের’ সামনে। এই ক্লাব সামাজিক উন্নয়নের কোনো কাজ করে না। ক্লাবে তাস খেলা, আড্ডা হয়। কখনো কখনো নানা অজুহাতে মহল্লার দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয় ক্লাবের নামে।

পূর্ব রসুলপুরের ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর গলি সিরাজ তালুকদার এবং জাবেদ নিয়ন্ত্রণ করেন। সিরাজ নিজেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক পরিচয় বলে দেন। তিনি সবার কাছে ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত।

অভিযোগ আছে, সিরাজ স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। কাউন্সিলর কামরাঙ্গীর চর থানা আওয়ামী লীগের ২৪ নম্বর সদস্য।

পশ্চিম রসুলপুরে একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মশিউর ও তাঁর সহযোগী শহীদুল্লাহ।

সম্প্রতি স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে কামরাঙ্গীর চরের তিনটি ওয়ার্ডের ১১০০ পরিবারের জন্য তিন হাজার টাকা করে সহায়তা পাঠানো হয়। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৫০টি পরিবার পায় এই সহায়তা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এবং সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সহায়তার টাকা তাদেরকেই দেওয়া হয়েছে, যারা কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের কাজে আসে, মিছিল-সমাবেশে থাকে। আর পেয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

ওই ওয়ার্ড শাখা আওয়ামী লীগ সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কাউন্সিলরই এমপি। কিশোর গ্যাং থেকে চাঁদাবাজি, মাদক সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কাউন্সিলর নিজের কোরামের সবাইকে এমপির সহায়তার টাকা ঈদ সালামির মতো বিতরণ করে দিয়েছেন।’

জানতে চাইলে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমি থানা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং এমপি সাহেবের প্রতিনিধির সামনে বিতরণ করেছি। এখন কে ঈদ সালামি বলল বা আর কী বলল সেটা ভাবছি না।’ কিশোর গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সিরাজ ছাড়া বাকিদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ থাকলেও কোনো অপরাধের সঙ্গে সিরাজ জড়িত না।’

ঢাকা উত্তর সিটির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে বিএনপি বস্তি। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কাউন্সিলর ফোরকান হোসেনের ভাতিজা শাকিল পারভেজ, দুই ভাগ্নে দেলোয়ার ও জুয়েল বস্তির কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। পারভেজের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাং সদস্যরা বস্তি ছাড়াও শিশু মেলা, বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র এলাকায় মাদকদ্রব্য বিক্রি, ছিনতাই, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপকর্ম করে বেড়ায়। এখন গ্যাং সদস্যরা ঈদ সালামির জন্য এলাকায় মহড়া দিচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার  ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘কিশোর গ্যাং নিয়ে সব সময় আমাদের তৎপরতা রয়েছে। যখনই আমাদের মনে হচ্ছে বাড়ছে, তখনই সামাজিকভাবে সচেতন করছি। এ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটতে পারে এমন তথ্যের ভিত্তিতে আগেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। সামনে ঈদ, তাই এটি নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।’

সূত্রঃ  কালের কণ্ঠ

Bootstrap Image Preview