Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৪ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

জাকাতের জন্য হিজড়াদের বাড়ি বাড়ি চিঠি: রাজধানীতে আতঙ্ক

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২১, ০৫:৩৮ AM
আপডেট: ১০ মে ২০২১, ০৫:৩৮ AM

bdmorning Image Preview


রাজধানীসহ সারা দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের পরিধি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছে। আগে দোকানপাটে সাহায্যের নামে মানুষকে জিম্মি করে চাঁদাবাজি করলেও এখন জাকাতের নামে সেই চাঁদাবাজি করে পৌঁছে গেছে বাড়ি বাড়ি। বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডদের দেওয়া হচ্ছে হুমকি। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের এসব কর্মকাণ্ড সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাদের জাকাতের আদলে এই নতুন পদ্ধতিতে যদি একবার টাকা আদায় শুরু হয় তাহলে তা থামার নয়। যেমন শুরু হয়েছে শিশু বাচ্চা জন্ম নিলে জিম্মি করে টাকা তোলা। তবে সমাধান হিসেবে তারা বলছে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সরকারি উদ্যোগের কথা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুরুর দিকে হিজড়ারা বাসায় বাসায় গিয়ে বাচ্চা জন্ম নিলে আদায় করত ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। পরববর্তী সময়ে এই টাকা আদায় করা হতো দুই থেকে তিন হাজারে। তবে বর্তমানে এই টাকা আদায় করা হয় পাঁচ থেকে দশ হাজারের মতো। এই টাকা তোলার কর্মকাণ্ডে নতুনভাবে এবার যুক্ত হয়েছে জাকাতের আদলে চাঁদাবাজি। যাকে মূলত এক ধরনের অপরাধ হিসেবেই দেখছেন সমাজবিজ্ঞারীরা। তবে তাদের এই কাজ অপরাধ হিসেবে মানতে নারাজ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। তারা বলছেন, আমরা জাকাত চাইছি কিন্তু কাউকে হুমকি দিচ্ছি না।

তবে তাদের এই জাকাত চাওয়া আর হুমকি দেওয়া যাই বলা হোক না কেন এই ঘটনায় বেশ আতঙ্ক বিরাজ করছে বাড্ডা এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দার মধ্যে। সেখানে হিজড়াদের দলে রয়েছে ৮৫ জন সদস্য।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু তৃতীয় লিঙ্গের থাকলেও কিছু পুরুষও আছে তাদের দলে। তারা নারীর বেশে বের হয়। তাদের এই দলের নেতৃত্ব দেন শামীমা নামের একজন। তবে তাকে মাঠে দেখা যায় না। তিনি থাকেন বাড্ডা এলাকার ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায়। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড্ডা এলাকায় বাসাবাড়ি আছে কমপক্ষে ৫ হাজার। সে হিসেবে বাড়ি প্রতি ৫০০ টাকা করে নিলে টাকার অংক দাঁড়ায় ২৫ লাখ। এই এলাকার পশ্চিম মেরুল অংশে বেশ কিছু বাড়িতে দেওয়া হয়েছে জাকাতের দাবিতে চিঠি। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে জাকাতের জন্য তাদের খুশি হয়ে কিছু টাকা দেওয়ার কথা। তবে এই চিঠির পেছনের গল্পটা আলাদা। কথা হয় সেই এলাকার একটি বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এই এলাকায় আজ অনেক বছর। এবারই প্রথম চিঠি দিছে। আগে তো এমন কিছু ছিল না। তারা শুধু চিঠি দিছে এমনটা নয় বরং আমাকে বলে গেছে, কমপক্ষে পাঁচ শ থেকে ১ হাজার টাকা করে তুলে রাখতে।’

একই বাড়ির বাড়িওয়ালা সাদিকুল্লাহ লিমন বলেন, ‘হিজড়াদের এই ধান্ধা নতুন, আর আমি মনে করি এই ধান্ধা একবার শুরু হলে আর শেষ হবে না। তাই আমরা চাই এসব ধান্ধা বন্ধ হোক। তিনি আরো বলেন, আমরা এই এলাকার স্থানীয়। জন্ম এখানে। তবে এবারই এরকম হচ্ছে। তারা জাকাত চাইতে পারে কিন্তু হুমকি দিতে পারে না।’  তবে এ বিষয়ে চিঠি দাতা লিজা হিজড়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা কাউকে হুমকি দেইনি, যে যা খুশি হয়ে দেবে আমরা তাই নেব।

দু’দিন আগে মেরুল এলাকায় বাসাবাড়িতে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি ঈদের কথা বলে টাকা তুলেছিল হিজড়া দলের সদস্যরা। টাকা দিতে না চাইলে দোকান থেকে জোর করে তারা মালামাল নিয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুদি দোকানদার বলেন, ‘লিজা আর লগে আরেকটা হিজড়া আইছিল যার কাছে যেমন পাইছে টেকা নিয়া গেছে। আমি নিজেও বাধ্য হইয়া ৫০ টাকা দিছি। এই দোকানের দিকে ইশারা করে বলেন, হ্যা টেকা দেয় নাই হের কাছ থ্যাইকা দামি সাবান নিয়া গেছে।’

একই এলাকার বাসিন্দা খোকন মিয়া। চার মাস আগে সন্তানের জন্ম হওয়ার কারণে তাকে দিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা। তবে তৃতীয় লিঙ্গের এই সদস্যরা দাবি করেছিল ১০ হাজার টাকা। খোকন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছেলে হয়েছিল গত চার মাস আগে, সে সময় তারা আসছিল ৫ হাজার টাকা নিয়া গেছে আর আমাকে দিছে বিশেষ কার্ড। বলছে আর কেউ আসলে এই কার্ড দেখাতে। এই কার্ড দেখলে আর কেউ তাদের কাছ থেকে টাকা নিবে না। আতঙ্কিত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, ‘এবার আসল আবার নতুন বিপদ জানি না কী হবে?’ 

অধিকাংশ এলাকাবাসীর আতঙ্ক একটাই কী হবে। আর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চাহিদাই বা কত টাকা। সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনিলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জিয়া রহমান বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের এটি একটি ‘সাবকালচার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্যই এটি একটি ‘নেগেটিভ সাবকালচার’। যদি তারা কোনোভাবে মানুষকে কষ্ট দিয়ে জোর করে টাকা নেয় অবশ্যই তা অপরাধ। সরকারের উচিত রাষ্ট্রের উচিত এই অপরাধ বন্ধ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। 

জানতে চাইলে বাড্ডা থানার ওসি মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা আপনার কাছেই অবগত হলাম। কোনো অভিযোগ পেলে আমরা এই চক্রের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ 

হিজড়া অধিকার সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইভান আহমেদ কথা বিষয়টি সম্পর্কে রবিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, বাড়িতে বাড়িতে চিঠি দিয়ে এভাবে টাকা আদায় হিজড়াদের পেশার মধ্যে পড়ে না। তাঁদের পেশার মধ্যে রয়েছে ‘ছল্লা’ ও ‘বাধাই’। ‘ছল্লা’ হচ্ছে ছোট ছোট দোকান থেকে আর্থিক সহযোগিতা হিসেবে ৫/১০ টাকা নেওয়া। আর ‘বাধাই’ হচ্ছে নবজাতককে নিয়ে আনন্দ করে কিছু বকশিশ নেওয়া। বিভিন্ন দেশে যৌনকর্মও তাদের অন্যতম পেশা।

ইভান আহমেদ কথা আরো বলেন, বাসায় বাসায় চিঠি দিয়ে টাকা আদায় তাদেরকে দিয়ে কেউ করাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া দরকার। তাদের কোনো গুরুর নামে এটা করছে কিনা, করে থাকলে সেই গুরুর কাছে এর জবাব চাওয়া যেতে পারে। চিঠিতে কার নাম আছে সেটা দেখতে হবে। এলাকার কোনো চাঁদাবাজ চক্র তাদের ব্যবহার করতে পারে। ওই চক্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। তবে মনে রাখতে হবে হিজড়ারা সমাজের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এরা সব সময় অবহেলার শিকার। মানবিক কারণে তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণা জাগানো কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

Bootstrap Image Preview