গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাটে মোসারাত জাহান মুনিয়ার আত্মহত্যায় চট্টগ্রামের হুইপপুত্র শারুণের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা।
ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা বলেন, ‘এই ঘটনার নেপথ্যে আরও অনেক কাহিনি আছে। এই মেয়ে (মুনিয়া) তো একটা সাইকো ছিল। আনভীর ভাই বিবাহিত জানা সত্ত্বেও কেন তার দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেছিল? তাকে তো আগে আমরা কুমিল্লায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সে লোভী। সে একটা... (প্রকাশযোগ্য নয়)।’
এ ঘটনায় চট্টগ্রামের হুইপপুত্র শারুণের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এ সংক্রান্ত কথোপকথনের কয়েকটি স্ক্রিনশটও পাঠান এই প্রতিবেদকের কাছে। সেখানে মুনিয়া শারুণকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আমার পরিবারকে একটু দেইখেন।’ শারুণকে কিছু কল রেকর্ড ও স্ক্রিনশট দিয়ে মৃত্যুর পর এসব সবাইকে দেওয়ার জন্য বলেন মুনিয়া।
আসলেই কি মুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল হুইপ সামসুল হক চৌধুরী-পু্ত্রের? জানতে মুঠোফোনে বুধবার রাতে কথা হয় শারুন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যে স্ক্রিনশটগুলো ছড়িয়েছে এগুলো বানিয়ে আমার নামে যুক্তিহীনভাবে চালানো হচ্ছে। আমি এটার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এগুলো একদমই বানোয়াট।’
স্ক্রিনশটগুলো দেখে স্পষ্ট হওয়া যায়নি এগুলো কোন তারিখের। তবে সময় বিকাল চারটা ৪৯ মিনিট থেকে সোয়া পাঁচটার কিছু পরের। ওই হোয়াটসঅ্যাপ আলাপে দেখা যায়, শারুন চৌধুরীর নম্বর থেকে ‘হাই’ বলে নক করা হয় মুনিয়াকে। পরে মুনিয়া জানতে চান, তিনি কেমন আছেন? জবাবে শারুন বলেন, ‘এই তো কোনোরকম। কী অবস্থা তোমার?’ জবাবে মুনিয়া লেখেন, ‘ভালো না।...’ এর পরই আলাপ গড়াতে থাকে সামনে। যেখানে মুনিয়ার সঙ্গে শারুনের আর্থিক লেনদেনের একটি আলাপও স্পষ্ট হয়।
যদিও শারুন বরাবরই দাবি করে আসছেন, মুনিয়ার সঙ্গে তার কখনো আলাপ হয়নি। আর স্ক্রিনশটে যেভাবে কথোপকথন চালানো হয়েছে সেটিরও তার নিজস্ব কথা বলার ধরনের সঙ্গে কোনো মিল নেই। শারুন বলেন, ‘আমার লেখার একটা স্টাইল আছে। স্ক্রিনশট মেকার দিয়ে এটা বানানো। আপনিও চাইলে একশটা বানাতে পারবেন।’
তিনি ওই কথোপকথনের ফরেনসিক করার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘মুনিয়ার সাথে যে চ্যাটের কথা বলছে এটা পৃথিবীর যেকোনো ফরেনসিক রিপোর্টেকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলতে পারি এটা ভুয়া। আমার সাহস না থাকলে কি ফরেনসিকের কথা বলতাম? মুনিয়ার মোবাইল তো পুলিশের কাছে আছেই। ফরেনসিক রিপোর্টটা ডিলিট করলেও ফরেনসিকে থাকে।’
এই কথোপকথনের সূত্র ধরে শারুন চৌধুরীর কাছে ফোন করে মুনিয়ার ব্যাপারে তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে একটি গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শারুন বলেন, ‘একদম পুরো মিথ্যা কথা। পুলিশের সাথে আমার এখন পর্যন্ত কোনো হ্যালো পর্যন্ত হয়নি। তাহলে কোত্থেকে আসল?’
সোমবার রাতে গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান (মুনিয়া) নামের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা করেছে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান। তাদের বাড়ি কুমিল্লায়।
কে এই পিয়াসাঃ ২০১৭ সালের মে মাসে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে নাম ছিল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার। প্রথমে মামলা করতে ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করেছিলেন পিয়াসা। কিন্তু সেই পিয়াসার বিরুদ্ধেই আবার মামলা তুলে নেওয়ার হুমকির অভিযোগে জিডি করেছিলেন ভুক্তভোগী। চার বছর পর আবারও আলোচনায় সেই পিয়াসা।
গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের হয়েছে, তাতেও পিয়াসার নাম রয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার তদন্তের স্বার্থে তারা পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, আমরা সব তদন্ত করে দেখছি। ঘটনায় সম্পৃক্ত সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গুলশান থানায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘গত ২৩ এপ্রিল সায়েম সোবহান আনভীর মুনিয়াকে হঠাৎ বকাঝকা করেন। মুনিয়া কেন ফ্ল্যাট মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছে এবং ছবি তুলেছে। ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে। এটা আবার পিয়াসা দেখেছে। পিয়াসা মালিকের স্ত্রীর ফেসবুক ফ্রেন্ড ও পরিচিত। পিয়াসা আনভীরের মাকে সব বলে দেবে। আর আনভীরের মা বিষয়টি জানতে পারলে মুনিয়াকে মেরে ফেলবে বলেও মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।’
এজাহারে পিয়াসার নাম উল্লেখ করায় প্রশ্ন উঠেছে কে এই পিয়াসা? পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, এই পিয়াসা হলেন ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা, যিনি চার বছর আগেও রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় আলোচনায় এসেছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জুয়েলারি শপ আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ ছিলেন ওই ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি। পিয়াসা ছিলেন সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী। রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ওই ঘটনার কিছু দিন আগেই সাফাতের সঙ্গে পিয়াসার ডিভোর্স হয়েছিল।
সে সময় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার তার ছেলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার নেপথ্য কারিগর হিসেবে পিয়াসাকে অভিযুক্ত করেছিলেন। পরে অবশ্য তাদের মধ্যে সমঝোতা হয় বলে খবর প্রকাশ পায়। ধর্ষণের শিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে সহায়তার কথা স্বীকার করলেও কয়েক দিনের মাথায় পিয়াসা তাদের মীমাংসা করার জন্য চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। এজন্য পিয়াসার বিরুদ্ধে দুটি সাধারণ ডায়েরিও করেন তিনি।
ওই ঘটনার পর দিলদার আহমেদ তার সাবেক পুত্রবধূ পিয়াসার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। পিয়াসাও সাবেক শ্বশুর দিলদার আহমেদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করেছিলেন।