ফারজানা শারমীন রিমি : এতদিনে মামুনুল হক কহিলেন বিষাদেঃ ফাঁস হওয়া ফোনকল গুলো রিয়েল; চক্রান্তকারীদের 'এডিট' করা না।
সেই সাথে তিনি যথারীতি দাবী করে যাচ্ছেনঃ
- জান্নাত আরা ঝর্ণা তার বৈধ স্ত্রী।
- তার প্রথম স্ত্রী কিছু না জানলেও, তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরা বিষয়টা জানে।
- স্ত্রীকে 'খুশি' করতে সীমিত পরিসরে মিথ্যা বলা ইসলামে জায়েয। (তাই তিনি নিজ দায়িত্বে স্ত্রীকে ফোন করে মিথ্যা বলেছেন এবং স্ত্রীকেও মানুষের কাছে মিথ্যা বলতে শিখিয়ে দিয়েছেন।)
এখন, তার ফাঁস হওয়া ফোনকলগুলোর কয়েকটা ধরে ধরে, তার এই 'বৈধ বিয়ে' ও 'সীমিত পরিসরের মিথ্যা' নিয়ে আমি কিছু প্রশ্ন তুলবো।
১। https://www.youtube.com/watch?v=lU6953FKGR0
- এই অডিওতে ২ মিনিট ২০ সেকেন্ড থেকে শুনলে দেখা যাবে, জান্নাত আরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে যে, মামুনুল হকের সাথে তার বিয়ে কোথায় হয়েছে। তিনি আমতা আমতা করে ফোনে বলছেন, "এখন আমি শরীফ ভাইকে জিজ্ঞেস করতেসি, এইটা আমি ঠিক কী বলবো, কোন জায়গায় হইসে? আমি জানি না; আপনি হুজুরের কাছ থেকে জেনে নেন..."।
মানে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যিনি দুই সন্তানের মা, নিজের পক্ষের কোনো অভিভাবক ছাড়া বিয়ে করছেন, তিনি জানেনই না, তার বিয়ে ঠিক কোথায় হয়েছে।
- এই কথোপকথনটুকুর পরেই মামুনুল হক বলছেন, "তুমিই যে এখানে, এটা শরীফ ভাই জানলো কীভাবে? মানে তোমাকেও দেখা গেছে, না কি?"
জান্নাত আরা উত্তরে বলছেন, "তা আমাকে দেখা গেছে না!..."
... এর মানে কী? তার 'দ্বিতীয় বিয়ে'র কথা যদি তার ঘনিষ্ঠজনরা জানেই, তাহলে শরীফ ভাই তো এমনিই বোঝার কথা, ওই নারী কে। চেহারা দেখে বুঝতে হবে কেন?
না কি এরকম 'দ্বিতীয় বউ' তার আরও আছে; তাই চেহারা না দেখলে ঘনিষ্ঠজনেরা বুঝতে পারবে না, এটা ঠিক কোন 'দ্বিতীয় বউ'?
২। https://www.youtube.com/watch?v=dCNxdMBeSpA
- এই অডিওতে ৩ মিনিট থেকে শোনা যাচ্ছে, মামুনুল হকের বোন তার ভাবীকে পইপই করে শিখিয়ে দিচ্ছে, যেন কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, "হ্যাঁ, আমি অনুমতি দিসি; আমার শাশুড়ি থাকতেই করায় গেসেন"।
এই সময় স্ত্রী কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলেনঃ "এগুলা (দ্বিতীয় বিয়ের কথা) কি সত্যি?"
বোন বলছে, "না না! সত্যি তো আর না। কিন্তু আমরা ভাইবোনরা, সবাই এখন সাপোর্ট দিতে হবে"।
- ৪ মিনিটের সময় বোন বলছে, "আমাদের জিজ্ঞাসা করলে আমরা এইটাই বলতেসি যে, হ্যাঁ, আমাদের আম্মাই করায় গেসে। ভাবীও জানে। আমরা এই বিয়ে মানি নাই তাই বাড়িতে উঠাইতে দেই নাই। এইজন্য হয়তো প্রয়োজন মিটাইতে হোটেলে-টোটেলে যায় আর কী। ... মানে, আমরা পরিবার যে জানি না, এইটা বলার দরকার নাই, বুঝছো?"
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, শুধু তার বউই না, তার পরিবারও এরকম কোনো বিয়ের কথা জানতো না।
৩। মামুনুল হক তার 'মানবিক বিয়ে'র গল্পে লিখেছেন, যতদিন মেয়েটার 'অভিভাবকত্ব' প্রয়োজন হয়, ততদিনের জন্য তিনি বিয়ে করেছেন। তার মানে, এটা তালাকের ইনটেনশন নিয়ে করা, 'অস্থায়ী বিয়ে' (যদি আদৌ কলেমা পড়ে বিয়ে করে থাকে)।
এরকম বিয়ে মেজরিটি স্কলারই অবৈধ বলেছেন; কারণ কুর'আন ও সুন্নাহর বৈবাহিক সম্পর্কের কনসেপ্টের সাথে এটা কোনোভাবেই যায় না।
যদিও বা কিছু স্কলার 'বিশেষ অবস্থায়' এটাকে 'অনুমোদনযোগ্য' বলেছেন, তারপরেও তাঁরা বলেছেন, বিয়েতে অভিভাবকদের লাগবে এবং বিয়ে সামাজিকভাবে 'অ্যানাউন্স' করতে হবে।
৪। হাদিস অনুযায়ী, বিয়ে অ্যানাউন্স না করলে সেটা বৈধ হবে না। হ্যাঁ, বিয়ে খুব অল্প মানুষ নিয়ে, সীমিত পরিসরে হতে পারে। কিন্তু তারা যে স্বামী-স্ত্রী, এটা মানুষের জানতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, "দেশের মানুষকে ঢোল পিটিয়ে, কিংবা ঘরে ঘরে গিয়ে জানাতে হবে না কি?"
- কেন রে ভাই? মামুনুল হকের প্রথম বিয়ের কথা কি তিনি ঢোল পিটিয়ে কিংবা ঘরে ঘরে গিয়ে জানিয়েছিলেন? প্রথম বিয়ের কথা আমরা জানি কীভাবে?
৫। বিয়ে অ্যানাউন্স করার হাদিস না মানলেও, "স্ত্রীকে খুশি করতে মিথ্যা বলা যায়" - এই হাদিস মামুনুল সাহেব মানেন।
হ্যাঁ, এরকম একটা হাদিস আছে। কিন্তু সেটা কেমন 'মিথ্যা' সম্পর্কে?
- উদাহরণ হলঃ সন্তান জন্ম দেওয়ার পর স্ত্রীর মাথার চুল পড়ে গেছে, ওজন বেড়ে গেছে; তাঁকে আর আগের মতো তেমন সুন্দর দেখাচ্ছে না। স্ত্রী এইরকম অবস্থায় স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, "আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?" - যদিও সত্যি বলতে, স্বামীর কাছে স্ত্রীকে তেমন সুন্দর লাগছে না, কিন্তু স্বামী বলতে পারেনঃ "তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে"।
(কমন সেন্সে বলে, এটা স্বামী-স্ত্রী দুজনের বেলাতেই প্রযোজ্য)।
আর তিনি না হয় হাদিস মেনে, নিজ দায়িত্বে ফোন করে, স্ত্রীকে খুশি করতে মিথ্যা বলেছেন।
না হয় সন্ত্রাসীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে বিপদে পড়ে, সঙ্গিনীর নামের জায়গায় প্রথম স্ত্রীর নাম-পরিচয় বলেছেন। সেটাও বুঝলাম।
কিন্তু হোটেলের রেজিস্ট্রিতে যে তিনি প্রথম স্ত্রীর নাম লিখে আরেকজনকে নিয়ে ঢুকেছিলেন, সেটা তিনি কাকে খুশি করতে কিংবা কোন বিপদে পড়ে করেছিলেন?
আল্লাহ্ সূরাহ বাকারার ৪২ নং আয়াতে বলেছেনঃ
"তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জেনেশুনে সত্যকে গোপন করো না"।
- বলাই বাহুল্য, মামুনুল হক এবং তার পরিবার ও স্বজনেরা আল্লাহ্কে এতোটুকু ভয় না করে, ঠিক এই এই কাজটিই করছেন।
৬। তার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, "ইসলামী দৃষ্টিকোণ এবং অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে" তিনি, তালাক হওয়া বিপদগ্রস্ত বন্ধুপত্নীর অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অথচ সেই মেয়ের বাবা-মা বেঁচে আছেন। কোনো মেয়ের বাবা-মা বর্তমান থাকতে, একজন বেগানা পুরুষ তার অভিভাবক হয় আর অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করে, - ইসলামের কোন বিধান অনুযায়ী?
যা হোক, অভিভাবকত্ব করতে হচ্ছে বলে, তিনি একটি 'ইসলামসম্মত', 'মানবিক বিয়ে' করেছেন।
কিন্তু তিনি দেশের আইন মেনে বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন নি। হাদিসের বিধান মেনে বিয়ে অ্যানাউন্সও করেন নি। মেয়ের বৈধ অভিভাবকরাও কিছুই জানেন না।
এইরকম 'চোরামি' বিয়েতে স্পাউজের লিগ্যাল অধিকারের কোনো বালাই থাকে না। স্পাউজ উত্তরাধিকারী হিসেবে কোনো সম্পদ দাবী করতে পারবে না। কোনো সন্তান এসে গেলে, ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রেই পিতৃমহোদয় পল্টি দেন। যেহেতু বিয়ের কোনো লিগ্যাল ডকুমেন্ট বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই, সেহেতু সন্তানের কোনো পিতৃপরিচয় ও অধিকার আদায় করার উপায় নেই।
মামুনল হক যদি সত্যিকার অর্থেই মেয়েটাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাইতেন, তাহলে এভাবে দলিলবিহীন, সামাজিক স্বীকৃতিবিহীন, চোরামি বিবাহ করতেন না। রিসোর্টে লোকজন হামলা করার পর, শুরুতেই মেয়েটাকে ফেলে দৌড়ে পালাতে চাইতেন না। বৈধ স্ত্রীর নামে হোটেলে রুম বুকিং দিয়ে, মেয়েটাকে নিয়ে ঢুকতেন না।
তিনি হয় এই মেয়েটাকে কোনোরকম বিয়েই করেন নি, আর নয়তো কোনো ভুজং-ভাজং টাইপের বিয়ে করেছেন।
... "আরে, আমরা তো স্বামী-স্ত্রীই। আমি তোমাকে কবুল করে নিলাম, যাও। কবুল কবুল কবুল। এই যে অমুক অমুক সাক্ষী।" - এই টাইপের বিবাহ আর কী! যে কারণে মেয়েটা নিজেও জানে না, বিয়ে কোথায় হয়েছে।
অর্থনৈতিক সাহায্য করার নামে, ভুজংভাজং বিয়ের নামে, তিনি মেয়েটাকে দিনের পর দিন রক্ষিতার মতো ইউজ করেছেন।
ইসলামে একাধিক বিয়ের যে গুরুত্বপূর্ণ শর্তঃ সমান অধিকার ও মর্যাদা, - সেটাও তিনি লঙ্ঘন করেছেন। তার প্রথম স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে স্ত্রীর পরিচয় ও সম্মান নিয়ে বাস করছেন। বিয়ের পর হিফয করেছেন। আর কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী চোরের মতো, নাম-পরিচয়হীনভাবে, হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্ত্রীর অধিকার অনুযায়ী ভরণপোষণও তিনি ঠিকমতো পান নি। নতুবা এতবড় একজন ইসলামী নেতার স্ত্রীকে কেন পার্লারে কাজ করতে হয়?
৭।
মামুনুল হকের আরেকটি ফোনালাপে, অপর প্রান্তের নারীটির কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, সে জান্নাত আরা নয়। এরকম আরও কয়েকটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। সম্ভবত ইনি মামুনুল সাহেবের ৩য়/৪র্থ 'মানবিক স্ত্রী'।
এখানে তিনি নারীটির বাসায় যেতে চাচ্ছেন, এবং নারীটি বলছেঃ "আসেন; কিন্তু রাত্রে থাকতে দিতে পারবো না"। আবার বলছে, "রাত্রে ১০ টার দিকে গেট বন্ধ করে দেয়; তার আগে দিয়ে আসেন"।
এবং মামুনুল হক মহিলাটির বাসায় গিয়ে কী খেতে চান, তা ব্যক্ত করছেন।
(এই ফোনালাপের লিংক কেউ চাইলে দেব। নোংরা জিনিস এখানে দিলাম না। আমার লেখার একটা সম্ভ্রম আছে।)
৮। মামুনুল সাহেব বলেছেন, এইসব ষড়যন্ত্র না কি তার প্রতি না; সব আলেম-ওলামা আর ইসলামের প্রতি।
হুজুর! নির্লজ্জতার সীমা আর কতো লঙ্ঘন করবেন? ইসলামের এত বড় ক্ষতি বাহিরের শত্রুরা করতে পারবে না, যতোটা আপনাদের মতো মিথ্যাবাদী পথভ্রষ্ট 'আলেম'গণ করছেন।
যারা আপনার কুকীর্তি ফাঁসের জন্য ন্যায়-অন্যায় সবরকম উপায় অবলম্বন করেছে, তারা পুরোপুরি রাজনৈতিক কারণে করেছে। এর মধ্যে 'ইসলাম'কে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। আপনার রাজনৈতিক শত্রুর অসংখ্য কুকীর্তির খতিয়ান আছে। কিন্তু তারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে উন্মাদ করে তোলে না। নিজেদের অপকর্মকে ধর্ম দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে না।
এই সরকারকে তো আমরা, সোনামুখ করে হ্যান্ডশেইক করতে করতে আপনাদের অনেক দাবী মেনে নিতেও দেখেছি।
আপনি নিজে ধর্মের নাম দিয়ে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন কেমন হবে, তার ফতোয়া দেন। দেশের মানুষ কন্যা সন্তানদের ক্লাস ফাইভের বেশি পড়াবে না, - এই শপথ করান। হুঙ্কার দিয়ে আজকে একে মুরতাদ, কালকে তাঁকে কাফির ঘোষণা করেন। আপনি নিজে জনগণকে দেশের আইন অমান্য করে ভাস্কর্য ভাঙার নির্দেশ দেন। জিহাদের ডাক দেন। দেশে শরিয়া আইন কায়েম করতে চান।
সেই আপনিই আজকে, দেশের আইন অনুযায়ী আপনার "ব্যক্তিগত স্বাধীনতায়" হস্তক্ষেপ করার বিচার চাইবেন বলছেন? দেশে শরিয়া আইন থাকলে হুজুর, এত বড় ইসলামি নেতা হয়ে এইসব জঘন্য মিথ্যাচার আর ভণ্ডামির জন্য আপনার কয় কাউন্ট শাস্তি হত, ভেবেছেন একবার?
আমি কিংবা আমার মতো অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই আপনাদের সাথে কোনো রাজনৈতিক শত্রুতা নেই। রাজনৈতিক শত্রুরা আপনার ব্যক্তিগত ফোনালাপ গণমাধ্যমে ফাঁস করে অবশ্যই বড় রকমের অপরাধ করেছে। এটার কঠোর বিচার হওয়া উচিৎ। কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়ার পরেও, আপনার ও আপনার অন্ধভক্তদের স্পষ্ট কুকীর্তি, হম্বিতম্বি, আর জঘন্যভাবে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বানানোর অপপ্রয়াস দেখে আমরা যার পর নাই বিব্রত ও ঘৃণা বোধ করছি।
এর মধ্যে আবার যখন আপনার কণ্ঠে ইসলামিক নেতা স্টাইলের বক্তব্য কানে আসে, তখন আপনার নোংরা আর মিথ্যায় জর্জরিত ফোনালাপগুলো কানে ভাসে। বমি পায় তখন, হুজুর! দেশের অনুগতপ্রাণ মুসলিমদের সাথে, আমাদের মুখভর্তি দাড়ি আর মাথায় টুপিওয়ালা বাবা-ভাই-শ্বশুর-স্বামীদের সাথে এরকম প্রতারণা কেন করলেন?