Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

একজন সিরিয়াল কিলারকে মুক্ত করতে বিজ্ঞানীরা কেন উঠেপড়ে লেগেছেন?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪ মার্চ ২০২১, ০১:০১ PM
আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২১, ০১:০১ PM

bdmorning Image Preview
ছবিঃ সংগৃহীত


একজন নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তার নিজের চার সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার। এমনই রোমহর্ষক সিরিয়াল কিলিং অপরাধের দায়ে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সেই মাকে। এরই মধ্যে ১৮ বছরের সাজা ভোগ করেছেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা তাকে নিয়ে নতুন তথ্য দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন তাকে মুক্ত করতে। তারা বলছেন এই অপরাধ তিনি করেননি। দশ বছরে একে একে তার সবকটি সন্তান শিশুকালে স্বাভাবিক কারণে মারা গেছে।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের হান্টার ভ্যালি এলাকার ক্যাথলিন ফলবিগের প্রায় ১৮ বছর আগের অপরাধ নিয়ে এখন এরকম ভাষ্যই শোনা যাচ্ছে বলে বিবিসি এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে।

ক্যাথলিনকে ২০০৩ সালে খুনের মামলায় ‘অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ নারী সিরিয়াল খুনি’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতদিন পর বিজ্ঞানীরা নতুন যেসব তথ্য নিয়ে এসেছেন তাতে এই মামলার রায় সঠিক কি না তা নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

গত সপ্তাহে ৯০ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করে মিজ ফলবিগকে ক্ষমা প্রদর্শনের এবং তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। স্বাক্ষর দানকারীদের মধ্যে রয়েছেন দুজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বর্ষসেরা অস্ট্রেলীয় খেতাব পাওয়া দুই ব্যক্তি, একজন প্রধান বিজ্ঞানী এবং অস্ট্রেলীয় অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জন শিন।

তিনি বলেছেন, এই মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে এখন যেসব বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসাগত তথ্য প্রমাণ দেখা যাচ্ছে, তাতে এই আবেদনে স্বাক্ষর করাটাই যৌক্তিক মনে করছি।

মিজ ফলবিগকে যদি মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে এটি হবে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে ভুল বিচারে শাস্তিপ্রদানের সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত।

এই পিটিশনে বিজ্ঞান এবং আইনের মধ্যে ব্যাখ্যায় যে বিশাল ফারাক রয়েছে তা উঠে এসেছে। মিজ ফলবিগের রায়ের বিরুদ্ধে কয়টি আপিল করা হয়েছিল। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া রায় ২০১৯ সালে যখন পুনর্বিবেচনা করা হয় তখনও অস্ট্রেলিয়ার আইনজীবীরা রায় দেন যে, তার দোষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তারা পরিস্থিতিগত তথ্যপ্রমাণ এবং মিজ ফলবিগের সে সময়কার একটি ডায়রিতে লিপিবদ্ধ কিছু ধোঁয়াটে তথ্যের ওপরই মূলতঃ জোর দেন। ফলে আইনজীবীদের সামনে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এই একটি রাস্তাই খোলা ছিল যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানদের ক্ষতি করেছেন এবং তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করাটাই ছিল এক্ষেত্রে একমাত্র পদ্ধতি, বলছেন সেসময় মামলার নেতৃত্বদানকারী সাবেক বিচারক রেজিনাল্ড ব্লাঞ্চ।

তথ্যপ্রমাণ যা ছিল তাতে মিজ ফলবিগ ছাড়া আরও কারোর পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব ছিল না। নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সরকার জনগণকে দুবছর আগে আশ্বস্ত করে যে, সমস্ত সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হয়েছে, তদন্তে কোনও ফাঁক রাখা হয়নি।

কিন্তু এবার বিজ্ঞানীরা জোরে দিয়ে বলতে শুরু করেছেন যে, তাকে দোষী প্রমাণ করার পেছনে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে। ‘বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা উপেক্ষা করা যায় না’, বলেন মানবদেহের জিন বিশেষজ্ঞ গবেষক অধ্যাপক জোসেফ গেজ।

শিশু ও জন স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষক অধ্যাপক ফিয়োনা স্ট্যানলি বলেন, ‘চিকিৎসাগত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণকে এই মামলায় অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং বিজ্ঞানকে ছাপিয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পরিবেশ ও পরিস্থিতিগত তথ্যের ওপর। ফলবিগ সন্তানদের মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের হাতে বিকল্প ব্যাখ্যা রয়েছে।’

কী সেই ব্যাখ্যা?

তারা বলছেন ক্যাথলিন ফলবিগের শরীরে জিনগত একটি পরিবর্তন হয়েছিল যে পরিবর্তন বংশগতভাবে তার দুই মেয়ে সারা ও লরার শরীরে যায় আর সে কারণেই মেয়ে দুটির মৃত্যু ঘটে।

ক্যাথলিনের শরীরে জিনের আরেক ধরনের পরিবর্তন হয়, যা ধরা পড়েছে তার দুই ছেলে ক্যালেব এবং প্যাট্রিকের ক্ষেত্রে, যা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে তারা মনে করছেন, যদিও এই পরিবর্তনটি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন।

মিজ ফলবিগের দুই কন্যা সন্তানের দেহে পরিবর্তিত এই জিন ২০১৯ সালে প্রথম আবিষ্কার করেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভাসির্টির ইমিউনোলজি এবং জিনোমিক মেডিসিনের অধ্যাপক ক্যারোলা ভিনুয়েসা এবং তিনিই এই মিজ ফলবিগের মুক্তির দাবিতে এই আবেদনের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি।

তিনি বলেছেন, ‘পরিবর্তিত এই নতুন ধরনের জিন কারো শরীরে এর আগে আবিষ্কৃত হয়নি। ক্যাথলিনের শরীর থেকে এই জিন তার দুই মেয়ের শরীরে গেছে, ক্যালএমটু (CALM2) নামে এই জিন থেকে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’

এদিকে এই জিন সম্পর্কে আরও গবেষণা চালান অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা এবং আমেরিকার বিজ্ঞানীরা এবং গত নভেম্বরে তাদের গবেষণার তথ্য চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ পায়।

মিজ ফলবিগের দুই কন্যা সন্তানের দেহে পরিবর্তিত জিন ২০১৯ সালে প্রথম আবিষ্কার করেন অধ্যাপক ক্যারোলা ভিনুয়েসা।

ডেনমার্কের বিজ্ঞানীরা মিজ ফলবিগের শরীরে পাওয়া এই জিনের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখতে পান যে এটি বেশ মারাত্মক ধরনের এবং এই জিন যেকোনো সময়ে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে এবং ছোট শিশুরা ঘুমের মধ্যে এর শিকার হয়ে মারা যেতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মিজ ফলবিগের দুই কন্যা সন্তানেরই মারা যাবার আগে প্রদাহ হয়েছিল এবং তারা মনে করছেন ওই প্রদাহের কারণে দুই শিশুর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।

বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, মিজ ফলবিগের দুই পুত্রসন্তানের শরীরেও বিরল একধরনের জিন পাওয়া গেছে। ইঁদুরের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে এই জিন থেকে খুব শিশু বয়সে দুরারোগ্য মৃগী রোগ হতে পারে যার থেকে মৃত্যু অনিবার্য।

জিন বিষয় এই গবেষণার ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন মিজ ফলবিগের চারটি সন্তানই স্বাভাবিক কারণে মারা গেছে।

মেলবোর্নের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক স্টিফেন কর্ডনার ২০১৫ সালে এই শিশুদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নতুন করে পর্যালোচনা করে মত দিয়েছিলেন যে, এই শিশুদের খুন করার কোনও আলামত তাদের শরীরে নেই। তাদের দম বন্ধ করার কোনও লক্ষণও শিশুদের শরীরে ছিল না।

তিন বছর পর, ২০১৮ সালে আর একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ- ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাথিউ অর্ড অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনকে বলেন, ‘অধ্যাপক কর্ডনারের সঙ্গে আমি একমত যে এই চারজন শিশুর প্রত্যেকেরই যে স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হয়েছে তার স্বপক্ষে ব্যাখ্যা রয়েছে।’

মিজ ক্যাথলিন ফলবিগের ভাগ্য এখন নির্ভর করছে এই পিটিশনের ফল কী হয় তার ওপরে। নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি আপিল আদালতে সম্প্রতি তার আরেকটি আবেদনের শুনানি হয়েছে। মিজ ফলবিগ প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন তিনি নির্দোষ।

Bootstrap Image Preview