Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দেশে হঠাৎ মদ খেয়ে তরুণ-তরণীদের মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ১২:৪৪ PM
আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ১২:৪৯ PM

bdmorning Image Preview


মদ পানে মৃত্যুর সংখ্যা নতুন নয়। কিন্তু হঠাৎ করে মদ পান করে মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছে।  রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত দুই সপ্তাহে ভেজাল মদ পান করে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ তরুণী। কোথাও চোলাই মদ আবার কোথাও বিদেশি মদের নামে ভেজাল মদপানে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়।

গতকাল সোমবার ভুক্তভোগীদের স্বজন, হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তারা বলেছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করেই ভেজাল মদের সরবরাহ বেড়েছে। এসব মদ পান করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে মৃত ব্যক্তির কোনো স্বজন লিখিত অভিযোগ করছেন না।

গতকাল বগুড়ায় ভেজাল মদ পান করে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) এক ছাত্রী ও তার বন্ধু আরাফাতের মৃত্যু মদপানজনিত বলে বলছে পুলিশ। তবে সেটা ভেজাল মদ কি না তা জানা যায়নি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, প্রাথমিকভাবে অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানেই মৃত্যু হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। তবে মদের মধ্যে অন্য কোনো বিষাক্ত পদার্থ ছিল কি না তা পরীক্ষার আগে বলা যাচ্ছে না।

এর আগে ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তমাল নামে এক শিক্ষার্থী মদপান করার পর মগবাজারে রাশমনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সেখানকার চিকিৎসকরাও তমালের পাকস্থলীতে অ্যালকোহল বিষক্রিয়ার কথা বলেছেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। তবে হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে নারাজ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা  জানান, করোনাকালীন খ্রিস্টীয় নতুন বছর ও বিভিন্ন উৎসবে নামে তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন ব্যান্ডের মদের নামে প্রতারকদের কাছ থেকে ভেজাল মদ সংগ্রহ করেন। নিছক শখের বশে ঘরোয়া পরিবেশে সেই মদ পান করে এদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনই ঘটনা ঘটে রাজধানীর বাড্ডা খিলবাড়িরটেকে। গত ১৮ জানুয়ারি একসঙঙ্গ মদ পান করেন নাঈম, অভি ও তার স্ত্রী। এ সময় প্রথমে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন নাঈম। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অভি ও তার স্ত্রী নাঈমের মৃত্যুর খবর তার পরিবারের কাছে জানিয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরপরই অভির স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকেও আরেকটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি। অভি তার স্ত্রীর লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ময়মনসিংহের বাড়ির পথে রওনা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন। অভির এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, অভি ও তার স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। সেখানে মদের বিষক্রিয়তার কথা বলা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশন) আহসানুর রহমান  বলেন, বেশি মুনাফার লোভে বিদেশি মদের নামে ভেজাল মদ সরবরাহ করে থাকে অসাধু মদ বিক্রেতারা। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ মদপানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। তবে যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যায় সেসবের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তিনি আরও বলেন, ভিসেরা রিপোর্ট দেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্র্তৃপক্ষের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়ে থাকে।

এদিকে রাজধানীর একটি নামকরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের একটি টিম গাজীপুরে গিয়ে বিষাক্ত মদ পান করার পর টিমের ১৩ জন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে শিহাব, শরীফ ও কায়সার নামে তিনজন মারা যান। এছাড়া আরও ১০ জন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

ইউল্যাবছাত্রী ও তার বন্ধুর মৃত্যু অ্যালকোহলে! : রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে মৃত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর বন্ধু আরাফাতের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে পুলিশ। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর সিটি হাসপাতালে গত শনিবারই আরাফাতের মৃত্যু হয়। ঘটনা ধামাচাপা দিতে গোপনীয়তার সঙ্গে লাশ দাফন করা হয়। এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানান, ওই ছাত্রীকে ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ বা ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অতিরিক্ত মদপানজনিত তাদের মৃত্যু হয়েছে। গত রবিবার রাজধানীর ‘ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ওই ছাত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দল বেঁধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেন ওই ছাত্রীর বাবা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দর এলাকা থেকে এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা মদ সংগ্রহ করে। পরে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ব্যাম্বুস্যুট রেস্টুরেন্টে ছয়জন মিলে মদ পান করে। সেখানে তিন তরুণী ও তিন তরুণ ছিল। মদপান করার পর ছাত্রীকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দুই বন্ধু ওই ছাত্রীকে এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। তাদের মধ্যে আরাফাত নামে একজন মারা গেছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মর্তুজা রায়হান চৌধুরী নামক বন্ধু ওই ছাত্রীকে নিয়ে মিরপুর থেকে আরাফাতের বাসায় নিয়ে যান। আরাফাতের বাসায় স্কুটার রেখে আরাফাত, ওই ছাত্রী এবং রায়হান একসঙ্গে উবারের রাইড শেয়ারিং গাড়িতে করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুস্যুট রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহা এবং অন্য একজন সহপাঠী উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আসামিরা ওই ছাত্রীকে জোর করে অধিক মাত্রায় মদপান করান।

এজাহারে আরও বলা হয়, মদপানের একপর্যায়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী অসুস্থবোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে মোহাম্মদপুরের অন্য এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে যান। সেখানে ছাত্রীকে একটি রুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন রায়হান ও আরাফাত। এ সময় রায়হানের অন্য বন্ধুরাও রুমে ছিলেন। ধর্ষণের পর রাতে ওই ছাত্রী অসুস্থ হয়ে বমি করলে রায়হান তাদের আরেক বন্ধু অসিম খানকে ফোন করেন। অসিম পরদিন এসে ছাত্রীকে প্রথমে ধানম-ির ইবনে সিনা হাসপাতালে নেন। সেখানে ভর্তি না করায় আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ জানায়, ওই বাসায় যাওয়ার পর ছাত্রীর সঙ্গে তার দুই বন্ধুর শারীরিক সম্পর্ক হয়। একপর্যায়ে ওই ছাত্রী বমি করতে থাকলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। যারা মদ পান করেছিলেন এদের মধ্যে আরাফাত নামে এক যুবক অসুস্থ হয়ে শনিবারই মারা গেছেন।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে অতিরিক্ত মদপান এবং মদের সঙ্গে বিষাক্ত কিছু থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত মদপান করানোর পর বাসায় নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে, সেটাও মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে। প্রাথমিকভাবে আমরা মনে করছি, মদের সঙ্গে বিষাক্ত কোনো কিছু থাকতে পারে। আরাফাতের মৃত্যুর ব্যাপারে পুলিশ বলেছে, তার মৃত্যুর খবর আজ সোমবার (গতকাল) নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরাফাতকে কোথায় দাফন করা হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

ছাত্রীর মৃত্যুর বিষয়ে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনায়েত হোসেন বলেন, শনিবার সকাল ৭টার দিকে অসুস্থ ছাত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার দুই সহপাঠী। হাসপাতালে আনার পর দেখা যায় তার রক্তচাপ কম ও পালস পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টি ধানম-ি থানায় ও পরে মোহাম্মদপুর থানায় জানায়। পুলিশ এসে মৃতদেহ নিয়ে যায়। চিকিৎসকদের ধারণা, বিষাক্ত কোনো পানীয় বা মদপানে ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

বগুড়ায় ৫ জনের মৃত্যু : গত রবিবার রাতে বগুড়ার পুরান বগুড়া, ফুলবাড়ী ও কাটনারপাড়া এলাকায় বিষাক্ত মদ পান করে শহরের পুরান বগুড়ার লোকমানের ছেলে রাজমিস্ত্রি রমজান আলী (৪০) ও প্রেমনাথের ছেলে সুমন (৩৮), শহরের কাটনারপাড়ার টোকাপট্টির কুলি শ্রমিক সাজু (৫৫) ও বাবুর্চি মোজাহার আলী (৭০) ও ফুলবাড়ী সরকারপাড়া এলাকার আবদুল জলিল (৬৫) নামে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শহরের তিন মাথা এলাকায় ঋষি পরিবারের ছেলে চঞ্চলের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল রবিবার রাতে। সেই উপলক্ষে বিয়ে বাড়িতে আসা লোকজন পার্শ্ববর্তী শাহীনের হোমিও দোকানে মদ পান করেন। রাতে বাড়ি ফিরলে সুমন তার বাবা প্রেমনাথ ও চাচা রামনাথ এবং প্রতিবেশী রমজান অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভোররাতের দিকে তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমনকে মৃত ঘোষণা করেন। মদপানে অসুস্থ দুই ভাই প্রেমনাথ ও রামনাথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া রমজান স্থানীয় একটি ক্লিনিকে মারা যান। অন্যদিকে শহরের কালীতলা এলাকায় রবিবার রাতে অ্যালকোহলজাতীয় মদ পান করেন সাজু, মোজাহার ও আবদুল জলিল। রাতে বাড়ি ফিরলে অসুস্থ হয়ে তিনজনই মারা যান। বগুড়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরুণ কুমার চক্রবর্তী বলেন, তিনজনই কালীতলা বাজার এলাকায় অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করে অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই মারা যান। বগুড়া সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবীর জানান, যারা মারা গেছেন প্রত্যেকের বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। তবে মৃত ব্যক্তিদের পরিবার থেকে বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর কথা অস্বীকার করা হয়েছে। এর আগে গত বছর ২৮ অক্টোবর মাগুরায় মদ পান করে বিপ্লব কুমার দাস (১৬) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। এছাড়া মদের বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আরও আটজন। গত ১ ও ২ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়। তারা সবাই বিষাক্ত মদ পান করেছিলেন। এর আগে ২০১০ সালের ২১ আগস্ট সিলেটের বালাগঞ্জে বিষাক্ত মদপানে ১৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হয়।

Bootstrap Image Preview