সাইফুল ইসলাম।। যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন, তাদের সামনে ‘নিউক্লিয়াস’ শব্দটি মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে, আবার ডুবে যায়। এই ডুবসাঁতার খেলা সৃষ্টি করে এক ধরণের কৌতুহল। নিউক্লিয়াস নেতা সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যতো আলোচনা-সমালোচনা হয় তা অন্য কোনো রাজনীতিকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। নিউক্লিয়াস ও তার নেতা সিরাজুল আলম খানকে বলা হয়- ‘র’ ও ‘কেজিবি’ তার স্রষ্টা, আবার সম্পূর্ণ বিরোধী ধারার সিআইএ-মোসাদের নামও যুক্ত হয়েছে। সিরাজুল আলম খানের নামের সাথেও যুক্ত হয়েছে নানা খেতাব। খেতাবগুলোর মধ্যে মুজিবের গুন্ডা, মুজিব বিরোধী, তাত্বিক নেতা, কাপালিক, আন্দোলনকারী, যড়যন্ত্রকারী অন্যতম। একটি খেতাবতো তাকে রীতিমতো ঘেরাটোপেই আটকে ফেলেছে, তা হলো ‘রাজনীতির রহস্যপুরুষ।’
অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানকে নিয়ে যে মোহ সৃষ্টি হয়েছিল তাতে শেষ পেরেকটি ঢুকে দেয় ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন। এ সময় জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে গৃহস্থরা লাউ-কুমড়ার জাংলা ভাঙতে বাধ্য হন। কচি ডগার লাউ-কুমড়ার জাংলা ভাঙতে গিয়ে ভাঙে কৃষকের স্বপ্ন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সুপ্ত আকাঙ্খা যা ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’গানে জনে জনে কানে কানে বলে বেড়াত, তা আবারো জেগে ওঠে। মধ্যবিত্তদের মধ্যে দেখা যায় বাংলার স্বাধীনতার বেশ কিছু উদ্যোগ। এসব উদ্যোগের কোনোটা সীমাবদ্ধ থাকে দু-একটি বৈঠকের মধ্যে। আবার কোনোটা আটকা পড়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা জালে। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’সংক্ষেপে ‘নিউক্লিয়াস’ও স্বাধীনতার এমনি একটি উদ্যোগ, যা ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পৌছে যায় স্বাধীনতায়। নিউক্লিয়াস নামটি গোপন থাকলেও তার নেতা সিরাজুল আলম খান কর্মকাণ্ড চালাতেন প্রকাশ্যে, যাতে ছিল নতুনত্ব, ছিল কৌশল। এই কৌশল, নতুনত্ব বুঝতে যারা অক্ষম তাদের কাছে বিষয়টি জটিল, রহস্যময়। আর যারা বিষয়টিকে সরলভাবে দেখেন তাদের কাছে সহজ।
১৯৬২-তে ছাত্রলীগের অপর দুই নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে সিরাজুল আলম খান গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’বা নিউক্লিয়াস। তারা আঙুল কেটে রক্ত ছুঁয়ে শপথ নেন, যতদিন পূর্ব বাংলা স্বাধীন না হবে ততদিন ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার পিছনে ছুটবেন না তারা।
নিউক্লিয়াস ছাত্রদেরকেই এদেশের রাজনীতির প্রধান শক্তি হিসেবে চিহ্ণিত করে। মুজিবের ৬ দফার মধ্যে স্বাধীনতার ভ্রুণ খুঁজে পায় নিউক্লিয়াস। ৬ দফাকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচীতে পরিণত করা থেকে ব্যপক প্রচারের দায়িত্ব পালন করে তারা। ১৯৬৯-এর ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন রাজপথ কাঁপিয়ে সামরিক শাসক আয়ুব খানের পতন ঘটায়। এ আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর নিউক্লিয়াস। আন্দোলনের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করা হয়। জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। রেসকোর্স ময়দানে তাকে এককভাবে সংবর্ধনা দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ সভায় তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এভাবে অন্যান্য নেতাদের ছাপিয়ে বাঙালি জাতির একক নেতায় পরিণত হন বঙ্গবন্ধু। এই সব ছাত্র কর্মীরাই ১৯৬৯-এ সংগঠন গড়ার লক্ষে যোগাযোগ শুরু করে শ্রমিক এলাকায়। সিরাজুল আলম খান হয়ে ওঠেন শ্রমিক এলাকার ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।’ তখন সিরাজুল আলম খান শ্রমিক এলাকার যেখানেই গেছেন একদিনের আলোচনায় তাদের টেনে এনেছেন নিজের পক্ষে, গঠন করেছেন শ্রমিক লীগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তারা পৌঁছে যায় কৃষক এলাকায়।
রাষ্ট্রের জন্য যারা বিপদজনক হয়ে ওঠেন তাদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’যেতে হয় কখনো কখনো। এই আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ার কৌশলও পাল্টে ফেলে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের সংগঠন পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কর্মীরা দুই পদ্ধতিতে কাজ করেছে। এক ধরণের নেতাকর্মীরা জনসভা, কর্মীসভায় বক্তৃতা করতো। তাদের বক্তৃতা হতো জনগণ ও কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এরা হয়ে উঠতেন জনগণের নেতা। অপর ধরণের নেতাকর্মীরা পিছনে থেকে নীতি নির্ধারণী সভাগুলোতে অংশ নিত। তারা সাধারণত প্রশাসন এমন কী জনগণের কাছেও থাকতো অপরিচিত। এরা জনগণের নেতা হয়ে উঠতো না, হয়ে পড়তো সংগঠনের নেতাকর্মীদের নেতা। বৈধ সংগঠন ও আন্দোলনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা- এই কৌশলে কাজ করায় নিউক্লিয়াসকে কখনোই রাজনীতির মাঠ থেকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি।
নিউক্লিয়াস জনগণের চেতনা-মেজাজ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করেছে বরাবরই। তাইতো ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার শপথ নিলেও পূর্ব বাংলার স্বাধিকার, ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন নিয়ে হেঁটেছে দীর্ঘদিন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার পর জনগণের কাছে যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই- তখনই উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীনতার পতাকা, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে প্রকাশ্যে হাজির করে স্বাধীনতার প্রশ্নটি। তখন জনতার চাপে পড়ে সকলেই এক ধারায় মিশে যেতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর হামলে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। শুরু হয় জনযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ।
নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত নেয়ার পদ্ধতিও ছিল ভিন্ন। জনগণের সবচেয়ে কাছে থাকা কর্মীদের কাছে থেকে এসেছে যেসব প্রস্তাব, নিউক্লিয়াস সেসব প্রস্তাবের সমন্বয় করে তা যথাসময়ে কাজে লাগিয়েছে। এ কথার সত্যতা মেলে ওই সময়ের কর্মকান্ডে যুক্ত থাকা বিভিন্ন জনের লেখা থেকে।
শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতা হয়ে ওঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। এ সম্পর্কে শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন তার ‘মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বইয়ে লিখেছেন, “৩ নভেম্বর, ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিধ্বণি’নামক মাসিক বুলেটিনে তৎকালীন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক সারথী ছদ্মনামে ‘আজবদেশ’শিরোনামে একটি লেখায় বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নেতার (শেখ মুজিবুর রহমান) নামের পাশে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। রেজাউল হক মুশতাক প্রদত্ত উপাধিটি ছাত্রনেতাদের (ছাত্রলীগ) মধ্যে যথেষ্ট আলোচিত হয়। (এর আগে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণত ‘বঙ্গশার্দুল’বলে সম্বোধন করা হতো। কিন্তু এই উপাধিটি শেরে-বাংলার সমার্থক হওয়ায় আমরা এটার ব্যবহার নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম।) জনাব তোফায়েল আহমেদ তার দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’উপাধিটি রেজাউল হক চৌধুরীর এই লেখা থেকেই গ্রহণ করা হয় বলে বিভিন্ন আলোচনায় স্বীকার করেন।” এভাবেই জনগণের সবচেয়ে কাছে থাকা কর্মীদের কাছে থেকে এসেছে বিভিন্ন শ্লোগান। পতাকা, স্বাধীনতার ইশতেহারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিয়েছে জনগণ সংলগ্ন কর্মীরাই।
ধীরে ধীরে সাধারণ কর্মী তথা জনগণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বাড়তে থাকে, জনগণ হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। জনে জনে, শতে শতে, হাজারো জনতা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ছত্রছায়ায় অনেকেই যুক্ত হন স্বাধীনতা যুদ্ধে। এদের বিভিন্ন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠির পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্ন। সিরাজুল আলম খান মনে করতেন, যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভেঙ্গে পড়বে ব্রিটিশ-পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো। সেখানে গড়ে উঠবে গণবাহিনী (পিপলস আর্মি), গণপ্রশাসন, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ব্রিগেড ইত্যাদি। কিন্তু তার হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ‘যে স্বাধীনতা যুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার কথা, তা হয়না। ঔপনিবেশিক কাঠামোর অস্তিত্ব বাঁচিয়ে সীমিত যুদ্ধে আটকে যেতে হয়।’ (৭ মে, ’৮৬- নির্বাচনে জাসদ কেন অংশগ্রহণ করতে পারলো না। পৃষ্ঠা ২।) অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন গণনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে বোঝার চেষ্টা করেন দেশের ভিতরে অবস্থিত বিভিন্ন শক্তি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকেও। এর মধ্যেই পাকিস্তানের ভেঙ্গে পড়া আমলা কাঠামো কিছুটা হলেও জোড়া লাগানো সম্ভব হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্যোগী শক্তি ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দুই ভাগই ২১ জুলাই ১৯৭২ সালে প্রস্তুতি নেয় সম্মেলনের। সম্মেলনের দিন বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের সংখ্যালঘু অংশকে নিজের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ত্যাগ করেন সিরাজুল আলম খান সমর্থিত ছাত্রলীগের সংখ্যাগুরু অংশকে। সিরাজুল আলম খানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বটবৃক্ষ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের ছায়া তার উপর থেকে সরে যায়। তিনি হয়ে পড়েন সঙ্গীহীন, একা। তিনি বুঝতে পারেন যে, আজীবন বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেলেও রাজনৈতিক সহযোগিতা আর পাবেন না।
সিরাজুল আলম খানের রাজনীতির রহস্য সরলভাবে দেখলে কোনো রহস্য থাকে না। তবুও যদি তাকে কেউ রাজনীতির রহস্যপুরুষ ভাবেন, তাতে অন্য রহস্য থাকতে পারে।
সূত্র: পরিবর্তন