Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ছেলেশিশু কেন বড় হয়ে ধর্ষক হয়?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭ অক্টোবর ২০২০, ০১:৩৩ PM
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২০, ০১:৩৩ PM

bdmorning Image Preview


শেখ আদনান ফাহাদ।। ধর্ষণ কী? ধর্ষণ এক রকম যৌন অত্যাচার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার পরিসংখ্যান ব্যুরোর (১৯৯৯) হিসাব অনুসারে সেদেশের ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১ শতাংশ মহিলা ও ৯ শতাংশ পুরুষ। আর ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধী পুরুষ।

পুরুষ নিজেও নারী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আইনে একে ধর্ষণ বলা হয় না। কিন্তু এ নিয়ে এক নতুন সমীক্ষা চালানোর পর একজন গবেষক বলছেন, হয়তো এখানে পরিবর্তন আনার সময় হয়েছে। ব্রিটেনের ল্যাংকাস্টার ইউনিভার্সিটি লস্কুলের ড. সিওভান উইয়ার ২০১৬-১৭ সালে যুক্তরাজ্যে 'একজন পুরুষকে জোরপূর্বক যৌনমিলনে বাধ্য করার' ওপর প্রথম গবেষণা পরিচালনা করেন। (বিবিসি, ২০১৯)

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ দায়ী বিধায় একজন ‘পুরুষ’ হিসেবে ধর্ষণ নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। শুধু মেয়েশিশু নয়,ছেলেশিশুও ‘ধর্ষিত’ হয়। ছেলেদের বেলায় আমরা বলি ‘বলাৎকার’। ধর্ষণ ও বলাৎকার একই রকম অর্থ বহন করে কি না, এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজতে যাব না। আমার মতে, একই রকম ঘৃণ্য অপকর্ম। শুধু শিশু নয়, বড় ছেলেরাও অন্য কোনো ‘পুরুষ’ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে পারে। আর নারীর ওপর নির্যাতন তো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

পুরুষই সিংহভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বা অপরাধী। একটি ছেলেশিশু তার শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে একদিন ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠে। অনেক ছেলেশিশু আবার কৈশোরেই ‘পুরুষ’ হয়ে যায়।সব ছেলেশিশুই একদিন ‘পুরুষ’ হবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেকে দেখতে-শুনতে ‘পুরুষ’, কিন্তু প্রকৃত অর্থে ‘পুরুষ’ না। প্রকৃতপক্ষে তাহলে ‘পুরুষ’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কী তার বৈশিষ্ট্য? কী কী সামর্থ্য থাকলে একজনকে ‘পুরুষ’ বলা যায়? পাশাপাশি শিশুর সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণের সময় এসেছে বলে মনে করছি।

‘পুরুষ’-এর নানা বৈশিষ্ট্য বা সামর্থ্যকে বলা হয়ে থাকে পৌরুষ বা পুরুষত্ব। একজন আদর্শ পুরুষের ‘পৌরুষ’ কেমন হতে পারে। ‘পৌরুষ’ কি শুধু যৌনতা-ভিত্তিক বৈশিষ্ট? নাকি মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সুস্থ এবং সুষ্ঠু ধারণাও ‘পৌরুষ’-এর অনিবার্য বৈশিষ্ট্য? ঠিক কোন পর্যায়ে বা কী কারণে একটি ছেলেশিশু ধর্ষক হয়ে ওঠে? আমাদের সমাজে, পরিবারে, টেলিভিশনে বা সিনেমার পর্দায় কি এমন কিছু আছে যা সেদিনের ছেলেশিশুকে আজ ধর্ষকে রূপান্তর করছে? জীবনের সবকিছু ছাপিয়ে কারও কারও কাছে কি তবে যৌনতাই প্রধান বিষয় বা চাহিদা হয়ে উঠছে।

ড. খুরশিদ আলমের লেখা ‘সমাজবিজ্ঞানের ধ্রুপদী ও আধুনিক তত্ত্ব’ শীর্ষক গ্রন্থের ১১৬ নম্বর পৃষ্ঠার শুরুতে বিধৃত আছে, বহুল আলোচিত শরীরতত্ত্ববিদ এবং মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন যে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তিন বছর বয়স থেকে গড়ে ওঠে। মজার বিষয় হলো, ফ্রয়েড নিজে তার তিনবছর বয়সের জীবন সম্পর্কে কোনো কথাই মনে করতে পারেননি। ফ্রয়েড-বর্ণিত ‘লিবিডো’ ধারণা দিয়ে আমরা মানুষের ‘যৌনবোধ ও কাম’-এর সূচনাকাল সম্পর্কে জানতে পারি। খুরশিদ আলমের বই থেকে জানা যায়, ‘শিশুকাল থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত মানবদেহে যে কামপ্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকে, ফ্রয়েড তাকেই লিবিডো বলছেন। ‘লিবিডো হলো কামজ সহজাত প্রবৃত্তি। কাম বলতে শুধু বয়সের লৈঙ্গিক স্তরকে বোঝায় না। জীবনের সবকিছুর মূলে একমাত্র যৌনপ্রেরণাকেই ফ্রয়েড স্বীকার করেছেন। লিবিডোর দুটি বিশেষ ধরনের উল্লেখ করেছেন ফ্রয়েড, যার সাথে ‘নিপীড়নের মাধ্যমে’ ‘যৌনসুখ’ লাভ করার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। একটি হলোMasochism বা মর্ষকাম, আরেকটি হল Sadism বা ধর্ষকাম। মর্ষকাম হলো ব্যক্তির আত্মপীড়নের মাধ্যমে যৌনসুখ লাভ করা এবং ধর্ষকাম হলো নিপীড়ন করে যৌনসুখ লাভ করা।

একটি ছেলে বড় হয়ে কোন পর্যায়ে বা কী পরিস্থিতিতে ধর্ষক হয়ে ওঠে? পরিস্থিতি বিশ্লেষণে আমরা দুই রকমের ধর্ষণের ঘটনা দেখতে পাই। সাময়িক উত্তেজনায় একজন পুরুষ ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। আবার পরিকল্পনা করে, টার্গেট নারীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনকেই ধর্ষণ বলা যায়। বনানীর একটি হোটেলে দুই ‘মেয়েবন্ধু’কে জন্মদিন উদযাপনের কথা বলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশ তোলপাড় হয়েছিল। এডাল্ট নয় শুধু, চার-পাঁচ বছরের মেয়েশিশুও ধর্ষিত হয় বলে সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে খবর দেখা যায়। একজন পুরুষ এই আগ্রাসন কেন চালায়? শুধুই কি যৌনকামনা চরিতার্থ করার জন্য ধর্ষণ করা হয়? নাকি পুরুষের ‘শক্তি’ বোঝানোর জন্য ধর্ষণ করা হয়? কিংবা ধর্ষণ কি কারও কাছে প্রতিশোধের উপায়?

একটি ছেলেশিশু কীভাবে বড় হচ্ছে; পরিবারে, সমাজে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শরীর, মন, মেয়ে, নারী ইত্যাদি শব্দ বা সত্তার সঙ্গে কীভাবে পরিচিত হচ্ছে, সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টেলিভিশনে বা সিনেমার পর্দায় সে নারীকে কীভাবে উপস্থাপিত হতে দেখছে? পপুলার কমার্শিয়াল ফিল্মে ভারতীয়রা আইটেম গার্ল নামে একটি বিষয় সফলভাবে যুক্ত করতে পেরেছে। আমাদের দেশের অসৃজনশীল নকলপ্রিয় নির্মাতারাও আইটেম গার্ল কনসেপ্ট চর্চা করছেন। একজন ভিলেন আইটেম গার্ল নিয়ে ‘মাস্তি’ করবেন না, সেটা যেন হতেই পারেনা। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমায় তো রাস্তায় মেয়ে দেখলেই ভিলেন ও তার দল ‘ধর্ষণ’ করার জন্য ধাওয়া করে। ধাওয়া খাওয়া মেয়েটি নায়িকা হলে নায়কের আকস্মিক হস্তক্ষেপে বেঁচে যায়। যদি সে হয় নায়কের বোন, কিংবা অন্য কোনো পক্ষ, তাহলে নির্দেশকরা মেয়েটির ধর্ষণের ব্যবস্থা করেন। খুবই রগরগে সে দৃশ্য। এমন চলচ্চিত্র বা আইটেম সং বা আইটেম গার্লের ব্যবহার সমাজে ছেলেদেরধর্ষণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ক্রিয়ায় অংশ নিয়ে উস্কানি দিচ্ছে কি না সেটা সরকার, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের ভাবতে হবে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে একটি গ্রামে। অন্যদিকে বনানীর সে ঘটনা ঘটেছিল একটি এক্সপেন্সিভ হোটেলে। বনানীতে ধর্ষক ও ভিকটিম উভয়পক্ষই ‘শিক্ষিত ও অবস্থাসম্পন্ন’। ফলে এখানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আসবেনা। কেউ কেউ বলছেন, মেয়েরা ওখানে গেল কেন? ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেকে মেয়েদের পোশাক নিয়েও কথা বলে। বোরখা পরেও যে অনেকে ধর্ষণ থেকে বাঁচতে পারেনা, তার উদাহরণ কুমিল্লার তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। এখানেই একজন পুরুষের ‘পৌরুষ’কে বোঝার সুযোগ আছে। কাপড় ছাড়া, কিংবা কাপড় কম থাকলেই কি মেয়েদের ধর্ষণ করতে হবে? পুরুষ কর্তৃক নারী ধর্ষণের ঘটনায় যারা নারীর দোষ খুঁজে বেড়ান, আমার মতে, তারাও কোনো না কোনো সময় ধর্ষক হয়ে উঠতে পারেন। যৌনতা দেহ ও মনের একমাত্র উপাদান নয়, অনেকগুলো উপাদানের একটা মাত্র। অন্যান্য উপাদানগুলো ছাপিয়ে যখন যৌনতা প্রধান হয়ে ওঠে, তখনই বিপত্তি বাধে। আপনার ছেলেসন্তান কী শিখে বড় হচ্ছে, সেটা এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।গবেষণা করে বলতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, পড়ালেখার পাশাপাশি একটি শিশুকে যদি খেলাধুলা, ব্যায়াম, সুস্থসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রাখা যায়, তাহলে যৌনতাকেই জীবনের প্রধানতম বিষয় হিসেবে শিখবেনা আমাদের সন্তানরা।

পুরুষকে অনুধাবন করতে হবে যে নারী ভোগ করার কোনো পণ্য বা দ্রব্য নয়। নারী একটি ভিন্ন সত্তা হলেও পুরুষের তথা সভ্যতার অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে নারীর ওপর। নারীকে ধর্ষণ করা বা নির্যাতন করা প্রকৃত পুরুষের জন্যও লজ্জাজনক। ধর্ষণ কোনোভাবেই পৌরুষের বৈশিষ্ট হতে পারেনা। ধর্ষণ দুর্বল পুরুষের অমার্জনীয় অপরাধ। সিনেমায়, নাটকে দেখালেও নারী আসলে ভোগ করার বিষয় নয়। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রদর্শন করেই কেবল একজন পুরুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারেন। এত কিছু বলার পরেও যে পুরুষ শোধরাবেনা, তার জন্য আছে পুলিশ, আইন, আদালত।

বনানীর ঘটনায় আমরা দেখেছিলাম, পুলিশ কর্মকর্তা মামলা না দিয়ে দুই-তিন দিন ভিকটিমদের ঘুরিয়েছেন। পুলিশ যদি মামলা না নেয়, আসামিদের গ্রেপ্তার না করে, তাহলে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। আদালত ব্যবস্থা নিতে পারে অথবা জনসাধারণ যদি হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসে তাহলেও পুলিশ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। নোয়াখালীর নারীর ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনায় আমরা দেখলাম, এক মাস আগের ঘটনা। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়াতে সবার টনক নড়েছে। গ্রাম্য রাজনীতি, বিশেষ করে গ্রাম্য মাতব্বরদের জন্য অনেক তথ্য প্রশাসনের কাছে পৌঁছায় না। আর প্রশাসন সদরে বসে মনে করে সবকিছু ঠিক আছে। এক মাস আগে একজন নারী এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। আর এতদিন ধরে প্রশাসন জানতে পারেনা!!এই ব্যর্থতা কার? বেগমগঞ্জের সেই গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছিলাম অক্টোবরের ৪ তারিখেই।

আমি আপনি চাইলেই সমাজ বদলে যাবে না। মানুষ হয়ে জন্মালেও কেউমানুষ হয় না, তাকে নির্মাণ করতে হয়। একজন মানুষ বড় হয়ে কি ধর্ষক হবে নাকি সুস্থ মানুষ হবে, এটা নির্ভর করে তার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ওপর। শিক্ষাব্যবস্থায় এত গলদ রেখে ধর্ষণমুক্ত সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়। শিক্ষা মানে এ বি সি ডি; অ আ ক খ কিংবা আলিব বা তা সা নয়। শিক্ষা মানে 'মানুষ' কী তার এহসাস, শিক্ষা মানে চরিত্র, শিক্ষা মানে সমাজে বদনাম হয়ে সম্মান হারানোর ভয়, শিক্ষা মানে শক্ত মানসিকতা, শিক্ষা মানেনর হয়ে নারীকে সম্মান করা, নারী হয়ে নরকে সম্মান করা। শিক্ষা মানে মন ও শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ।এখন বলুন, আমাদের সমাজ কি এমন? একজন সুস্থ পুরুষ নির্মাণ কী বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভব? ওই যে বললাম, পরিবার। পরিবার ও সমাজ মিলে ব্যক্তিকে তৈরি করে। সেখানে স্কুল, শিক্ষক, মাঠ, সংগীত, সিনেমা, ধর্ম- সব মিলেই মানুষ তৈরি হয়। সমাজ ঠিক না থাকলে পরিবারও দূষিত হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, সাংবাদিকতা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Bootstrap Image Preview