Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যাওয়া তিন মেয়ের গল্প

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ অক্টোবর ২০২০, ০২:৫৬ PM
আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২০, ০২:৫৬ PM

bdmorning Image Preview


ভারতের সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে কলকাতার নামও রয়েছে। কিন্তু এই শহরের রয়েছে অন্য একটি রহস্য। রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় নির্দিষ্ট কিছু মানুষের আনাগোনা এবং এশিয়ার বৃহত্তম পতিতাপল্লী খ্যাত সোনাগাছির নিশাচর জীবন সুন্দর এই শহরের মলিনতার চিত্র তুলে ধরছে যুগ যুগ ধরে।

হাজার হাজার কিশোরী, তরুণী ও নারীর স্বপ্ন পুড়ে ছাঁই হয়ে যায় এখানে। ছোটবেলায় যে কিশোরী স্বপ্ন দেখতেন একদিন শিক্ষক হবেন, মহান পেশায় নিয়োজিত হয়ে মানুষ গড়বেন। সেই কিশোরী বাস্তব জীবনের অন্ধকার গলি পেরিয়ে নিজের অজান্তেই চলে এসেছেন সোনাগাছিতে। তবে কেউ এসেছেন বাধ্য হয়ে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পেতে। আবার স্বেচ্ছায়ও এ পেশা বেছে নিয়েছেন অনেকে।

সময়ের আবর্তে সবকিছু বদলে গেলেও বদলায়নি সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের জীবনের গতিপথ। এমন তিনজন নারীর সোনাগাছিতে পৌঁছানোর গল্প তুলে ধরেছে ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

sonagachi-1

সোনাগাছিতে কীভাবে পৌঁছালেন কোহিনুর? প্রশ্ন করতেই জীবন গল্পের খই ফোটালেন কোহিনুর। বাবা-মা-ভাইকে নিয়ে ছোট্ট পরিবার ছিল। শৈশবেই মনে গেঁথে যায় শিক্ষক হওয়ার বাসনা। কিন্তু অভাব-অনটনের সংসারে তার এই ইচ্ছা যে বাস্তব রূপ পাবে না সেটাও জানতেন তিনি। তবুও স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষক হওয়ার।

নিজের লালিত স্বপ্নের কথা বান্ধবী শবনমকে জানালেন। এরপর দেখতে দেখতে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলো। কোহিনুরের স্বপ্ন সফল করতে শবনম বন্ধুকে নিয়ে এল কলকাতার শোভাবাজারে।

বাড়ি থেকে পালিয়ে শোভাবাজারে এসেছে দুই বান্ধবী। শবনম এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কোহিনুরকে। কোহিনুরের পরিবারের সদস্যরা এসবের কিছুই জানেন না। শবনমের পরিচয় করিয়ে দেয়া সেই ব্যক্তির সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন কোহিনুর। কিন্তু হঠাৎ সংবিৎ ফিরল তার।

যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতেন কোহিনুর, সেই ব্যক্তি তাকে নিয়ে এসেছে এমন এক জায়গায় যেখানে সবাই তাকে ছুঁতে চায়। মন চায় না, সঙ্গী করতে চায় না, চায় শুধু বিছানায়। কোহিনুরের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। কারণ এতদিনে তিনি জেনে গেছেন একবার এই রেডলাইটের কানাগলিতে কেউ ঢুকে পড়লে সেখান থেকে আর বেরোনোর কোনও উপায় নেই।

কিন্তু যে মেয়ে শুধু পড়বে আর পড়াবে বলে বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে এসেছে, তাকে চার দেয়ালে বন্দি রাখা সহজ নয়। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন খদ্দের আসে, সময় কাটায়, আবার চলে যায়। কিন্তু তার আর দিন বদলায় না।

এর মাঝেই নতুন একজনকে খুঁজে পান কোহিনুর। নতুন এই খদ্দের তাকে সিনেমা দেখাবেন বলে সোনাগাছি থেকে বাইরে নিয়ে আসেন। পরে সেখান থেকে চলে যান বিহারে। কোহিনুরের সঙ্গে ঘর-সংসার শুরু করেন এই ব্যক্তি। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিছুদিন পর কোহিনুরের গর্ভে আসে সন্তান। এমন সময় তিনি জানতে পারেন, যাকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন তিনি, তার আরও সংসার আছে, স্ত্রী-সন্তান আছে।

এ নিয়ে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। প্রত্যেকদিন স্বামীর মারধর সহ্য করতে না পেরে আবারও ফিরে যান সোনাগাছির অন্ধকার গলিতে। সেখানে তার কোল আলো করে এল ছেলে সন্তান। মায়ের পরিচয় লুকিয়ে ছেলেকে দূরে রেখে মানুষ করতে চাননি কোহিনুর। বরং ছেলে যেন মায়ের সংগ্রাম দেখে, সেটাই চেয়েছিলেন তিনি।

sonagachi-1

মাসের পর মাস রুমের বাইরে ছেলেকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতেন, ভেতরে খদ্দেরের মনোরঞ্জন করতেন কোহিনুর। প্রায়ই ছেলের কান্না আর খদ্দেরের মেজাজ মিলেমিশে বালিশ ভেজাতেন এই নারী।

নিজে শিক্ষক হতে পারেননি, তাই ছেলেকে দিয়ে সেই স্বপ্ন স্বার্থক করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন মা। কোহিনুরের ছেলে এই পল্লীতে থেকেই পড়াশোনা করলেন, শেষ পর্যন্ত মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে ছেলে শিক্ষকও হয়ে গেলেন। এরপর যৌনকর্মীর সঙ্গেই ছেলের বিয়ে ঠিক করলেন কোহিনুর।

ছেলেকে জীবনের সার শিক্ষা দিয়েছেন; তাই পুত্রবধূ নির্বাচনে কোনও দোলাচল ছিল না। তবে, বিয়ের পর কোহিনুরের পূত্রবধূ কেবল ঘর-সংসারই করছেন। কোহিনুরের দুই নাতি-নাতনি। সকালবেলা তাদের পড়াতে বসান কোহিনুর,‘অ’তে অজগর আসছে তেড়ে, আ’তে আমটি খাব পেড়ে’…কোহিনুর যে শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন!

হাড়কাটার আরেক তরুণী নীলিমা। মুর্শিদাবাদের এই তরুণীর সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। কলকাতা শহর কোনোদিন দেখেননি তিনি। বিয়ের পর স্বামীকে সে কথা জানান। স্বামী দেরি না করে তাকে নিয়ে সোজা চলে যান কলকাতা। ভিক্টোরিয়া, হাওড়া ব্রিজ, জাদুঘর, গড়ের মাঠ-সহ ঐতিহ্যবাহী সব স্থাপনা দেখার ইচ্ছা ছিল নীলিমার। স্বামী বললেন সবই হবে, কিন্তু আপাতত এক ‘বন্ধু’র বাসায় উঠতে হবে। বন্ধুর বাসায় উঠল নব দম্পতি। এরপর ‘একটু আসছি’ বলে বের হয়ে যান স্বামী।

সেই যে গেল আর ফিরে এল না। স্বামীর ‘বন্ধু’র পরামর্শে খুঁজতে বের হলেন তিনি। এরপর সেই ‘বন্ধু’র হাত ধরে আরেক ‘বন্ধু’র বাড়ি। হঠাৎ নীলিমা বুঝলেন, ‘বন্ধু’দের সৌজন্যে তার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এসে পড়েছেন কলকাতার হাড়কাটা গলিতে। সেই থেকেই নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নীলিমার নয়া জীবনযাপন শুরু। সকাল-বিকেল কাজ করে চলেছেন তিনি। এর সঙ্গে চলছে নাচ-গান শিক্ষা। এখন সবকিছুর সঙ্গে বেশ ভালই মানিয়ে নিয়েছেন নীলিমা।

হাড়কাটার হিসাবের খাতা বলছে, নীলিমার চাহিদা এখানে তুঙ্গে। বাবুরা তাকে প্রায়ই উপহারও দেন। বিয়ের প্রস্তাবও আসছে অহরহ। তবে এসব শুনলেই তার ঠোঁটে ঝিলিক দেয় চিলতে হাসি, পছন্দের টেডি বিয়ারটাকে জাপটে ধরে খোলা জানালা দিয়ে আকাশ দেখেন নীলিমা। নীলিমা শুনেছেন, ভিক্টোরিয়ার মাথায় পরীটা আর ঘোরে না, থেমে গেছে।

sonagachi-3

স্বামী-সন্তান নিয়ে আমিনা বিবির বেশ সুখেই কাটছিল দিন। সুখ আরও বাড়বে। কারণ, আমিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু, আচমকা স্বপ্নভঙ্গ! হঠাৎ মারা গেলেন আমিনার স্বামী। গর্ভে তখন পাঁচ মাসের সন্তান। শ্বশুরবাড়ি দায় ঝেড়ে ফেলল। এক সন্তানের হাত ধরে গর্ভবতী আমিনা গেলেন বাবার বাড়ি। কিন্তু বাবার সংসারে অনটনের শেষ নেই।

একদিন বাবা জানিয়ে দিলেন, তিনি আর পারছেন না। কিন্তু মেয়ে-নাতিকে ফেলে দিতে তো পারেন না। বসিরহাটে এক পরিচিত বন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন কাজের আশায়। সেই ব্যক্তি তাকে কাজের আশ্বাসও দেন। কিছুদিনের মধ্যে আমিনা কাজ পেয়ে যান; এই কাজ পেলেন মাটিয়ার যৌনপল্লিতে।

এরপর দেখতে দেখতে কুড়ি বছর সেখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন আমিনা। যে গর্ভের সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন আমিনা, সেই ছেলে মায়ের পরিচয় জেনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। নিজের থেকে দূরে রেখে বোর্ডিংয়ে ভর্তি করে ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন মা। কিন্তু মায়ের পেশার কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়ে ছেলে, মাধ্যমিকের পর ছেড়ে দেয় পড়াশুনা।

অন্যদিকে, মেয়ের শর্তাধীন বিয়ে হয়েছে। সেই মেয়ের কোল আলো করে এসেছে এক কন্যা। কিন্তু মেয়ে-নাতনি কাউকেই দেখতে পান না আমিনা। শ্বশুরবাড়ি থেকে শর্ত দেয়া হয়েছে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে না। কিন্ত আমিনার মন কাঁদে সবসময়। মরার আগে একবার মেয়ে-নাতনিকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে চান আমিনা।

Bootstrap Image Preview