Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘চাল চোর’ ওরা আওয়ামী লীগেরও শত্রু

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৫০ AM
আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৫০ AM

bdmorning Image Preview


কোভিড–১৯ এর টেস্টে সংকট। চিকিৎসায় সংকট। শুধু ত্রাণ পর্যাপ্ত। কিন্তু তার বিতরণে চলছে সংকট। কেউ বলছেন, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ত্রাণচুরি যে হারে সংক্রমণ ঘটেছে, তা করোনার চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার বলেছেন, ‘দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক ত্রাণ কমিটি করতে হবে। ত্রাণ সুবিধা পাওয়ার উপযোগীদের মধ্য থেকে দল-মত নির্বিশেষে যার যা প্রাপ্য, ঠিক সে অনুযায়ী দ্রুততার সঙ্গে তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। এই তালিকা অনুযায়ী প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণকাজ পরিচালনা করতে হবে।’ প্রশ্ন উঠেছে, তালিকা নির্দলীয় ও নির্মোহ হবে কিনা।

সরকারি সদিচ্ছা সাধুবাদ প্রাপ্য। কিন্তু এটা অর্জন করার বাস্তবতা দেশে আছে কিনা। সবারই জানা, তালিকা মানেই বিতর্ক। তালিকা মানেই তালগোল পাকানো। তালিকা মানেই প্রতিপক্ষের প্রতি বৈষম্য দেখানো। ইতিমধ্যে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে যে, কোথাও নিজেদের লোকেরা, বিতরণকারীদের স্বজন, বন্ধুবান্ধব দেদার ত্রাণ পাচ্ছে।

কোথাও অভাবী মানুষ সামান্য ত্রাণের জন্যও ধুকছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্মবিত্ত যারা ত্রাণ নেওয়া মর্যাদাহানিকর ভাবেন, তারা সবচেয়ে বিপাকে। হতদরিদ্র ত্রাণ না পেলে চিৎকার করে গলা ফাটান। কিন্তু মুখচোরা ওই বিত্তহীনরা নিরব থাকেন। তদুপরি সব মিলিয়ে ইতিমধ্যে পরিষ্কার দেশে ত্রাণচুরির মচ্ছব চলছে। পরিস্থিতি কতোটা নাজুক হলে সরকার দুর্নীতি রোধ করতে না পেরে ওএমওসের চাল বিক্রি কর্মসূচি বন্ধ করতে বাধ্য হতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করোনা প্রতিরোধ এবং জেলা পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম ‘সুসমন্বয়ের’ জন্য ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও এরইমধ্যে একটা বড় প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন ধরে দেশে বিভিন্ন বয়ষ্ক ভাতা, বিধবা ভাতা , ভিজিএফ ইত্যাদি যে চলছিল, তা নিয়ে কেন অনিয়মের প্রশ্ন গণমাধ্যমে আসেনি। এখন যারা ত্রাণচুরি করছে, তারাই তো সামাজিক নেতৃত্বে ছিলেন। এমন তো নয় যে,কোভিডের পরে তারা হঠাৎ স্থানীয় ক্ষমতায় এসেছেন। বুভুক্ষ, ক্ষুধার্ত মানুষই যে শুধু রিলিফ চোরদের বিরুদ্ধ সোচ্চার হয়েছেন, তাই নয়। এবার সোচচার হওয়াদের একটি বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের ভালো ও বিবেকবান মানুষেরা। আগে যা গোপন থাকতো, কারো মুখ খোলার উপায় ছিল না, এবারে সেখানে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক বিশ্লেষক তাই বলছেন, গণতন্ত্রের ঘাটতি শুধু ভোট নেয়নি। অপেক্ষাকৃত খারাপ লোকদের বেপরোয়া ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে।

এদেরকে বাছাই করা হয়েছিল মূলত পেশিশক্তি ও কালো টাকার বিবেচনায়। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের লোকেরা যে সাক্ষ্য দেবে, সেটাই হবে যথেষ্ট। কিন্তু এরকম নিরপেক্ষ তদন্ত আদৌ হতে পারে, সেই আশ্বাস করোনার দুর্যোগের মধ্যেও পাওয়া যায়নি। বরং একটি বাড়তি ট্রাজেডি যুক্ত হয়েছে। সেটা হলো স্তানীয় নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব জনগণের হাতে রইল না। এটা সরাসরি আরো বেশি শক্তি নিয়ে চলে গেল আমলাতন্ত্রের কাছে। আপাতত হয়তো এটাই ভরসা। এমনকি গত ৯ এপ্রিল ‘‘দেশের এমন পরিস্থিতিতে দলীয় লোকজনের মাধ্যমে’’ সরকারি ত্রাণ বিতরণ না করে, দায়িত্বটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত ১২ এপ্রিল ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। একইদিন ত্রাণ বিতরণের নামে কোনো রকম অনিয়ম সহ্য করা হবে না বলে সতর্ক করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে এরইমধ্যে বহিষ্কারও করা হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্যমূল্যের পণ্য বিক্রয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এক সপ্তাহ কেটে গেলেও তেমন কোনো ব্যবস্থার কথা জানতে পারেনি মানুষ। টিভির টকশোর আলোচনায় দৃষ্টান্তমূলক কোনো মামলা বা পদক্ষেপের কথা মানুষ এখনও জানতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ ত্রাণের দুর্নীতি ও ত্রাণের রাজনীতি দুটোর সঙ্গেই পরিচিত। কিন্তু কোভিড–১৯ এর মতো প্রাণঘাতি দুর্যোগ জাতির সামনে অতীতে কখনও আসেনি। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনে চলে যায়। এরপর শুরু হয় ত্রাণ বিতরণ। কিন্তু সেই চেনা দৃশ্যপট এবারে নেই। অতীতে ত্রাণে কমবেশি বিরোধী দলের একটা বাস্তব ভূমিকা থাকতো। কারণ ক্ষমতায় না থাকলেও দেশের স্থানীয় সরকারের উল্লেখযোগ্য অংশে তারা থাকতেন। তাই ত্রাণ বিতরণে আত্মসাতের কিছু ঘটনায় বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের একটা সম্পৃক্ততা ঘটতো। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় কোভিড–১৯ যেমন নতুন,তেমনি স্মরণকালের ইতিহাসে এই প্রথম পুরো দৃশ্যপটে ক্ষমতাসীন দলীয় সদস্যরাই গিজগিজ করছে। তারাই নিরঙ্কুশ। নায়ক তারা, পার্শ্ব নায়ক তারা। ক্যামেরার সামনে তারা। ক্যামেরার পেছনে তারা। অতীতে প্রশাসনে বিরোধী সমর্থকরা কেউ কেউ ছিলেন। কিন্তু এখন এটা ওপেন সিক্রেট যে, টানা ১০ বছরের শুদ্ধিকরণে ফ্রন্টলাইনে বিরোধী দলীয় সরব–নিরব কোনো সমর্থকেরই থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা এক দশকের শাসনামলে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানেনি। আইলা ও সিডরে ত্রাণ বিতরণ মানুষের স্মৃতিতে ফিকে হয়ে গেছে। এমন কিছুই ঘটেনি যাতে বাংলাদেশকে ত্রাণের জন্য বিদেশীদের শরনাপন্ন হতে হয়েছে। তবে এবারের পরিস্তিতি সম্পূর্ণ আলাদা। সামনে পরিস্থিতি কোথায় যাবে, তা কারো জানা নেই। পেশাদার কালোবাজারিরাও বসে নেই। সিন্ডিকেট দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু কোথাও আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে মোবাইল কোর্ট ভূমিকা রাখছে, কিন্তু তাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার সামর্থ্য দেখা যায় না। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড বিতরণে ঝালকাঠির নলছিটিতে মেম্বরের অনিয়ম, কুড়িগ্রাম সদরের ঘোগাদহ ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম মিয়ার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি ভুয়া তালিকা করে ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগ, রংপুরে এক ব্যবসায়ীর বাড়ির বক্সখাটের ভেতরে অবৈধভাবে মজুদ করে রাখা সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্যমূল্যের ১ হাজার ২৩৮ লিটার ভোজ্যতেল, চাদপুরে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের বাসা থেকে ২ টন ৩০ কেজি ও ৬৭ বস্তা ত্রাণের চাল, ঝালকাঠিতে ইউপি সদস্যের বাড়ি থেকে ত্রাণের ২৫ কেজি চাল, ১৩ এপ্রিল জামালপুরে যুবলীগ নেতার গুদাম থেকে ২১৬ বস্তা চাল উদ্ধার, কিশোরগঞ্জের প্রাথমিক তদন্তে খাদ্য গুদামে ৮১ টন চাল কম পাওয়া, এরকম খবরে গণমাধ্যম সয়লাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা নানাভাবে জড়িত।

এটা সবারই জানা যে, ভোট লাগেনি। ক্ষমতাসীন দলের টিকিটে মানেই বিজয়। তাই কারা কিভাবে এসব লোকদের মনোনায়ন দিয়েছিল, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। আশংকা করা হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার বা বরখাস্তের যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার ধারাবাহিতকতা বজায় থাকবে, এটা ভাবা হচ্ছে না। কারণ অভিযুক্তদের অনেকেই দলের বিভিন্ন পদে আছেন। সেকারণেই তৃণমূল আওয়ামী লীগের লজ্জিত ও বিব্রত অংশটি উদ্বিগ্ন। তারা ভাবছেন, কারো বিচার হবে না। বড়জোর তাদের দুএকদিন জেলের ভাত খেতে হতে পারে। এটাই শাস্তি বলে গণ্য হবে। এরথেকে বেশিদূর পানি গড়াবে না। বাংলাদেশের সমাজ থেকে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন উঠে গেছে। তারই করুণ পরিণতি ত্রাণচুরি। মুজিববর্ষে অনেকেই স্মরণ করছেন, জাতির জনকের সেই বিখ্যাত আক্ষেপ : সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেলাম চোরের খনি। শুধু এখানেই শেষ নয়, এবারে আরো ভয়ানক ঘটনাও ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল করেন এমন পরিচয়দানকারীরা সেলফিযুক্ত ত্রাণ দিচ্ছেন। ত্রাণ বিতরণের ছবি ধারণ করার পর সেই ত্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো অচিন্তনীয় দুর্নীতির তথ্যও মিলছে। গত ৭ এপ্রিল ত্রাণ দেওয়ার ছবি তোলার পর ২৬টি পরিবারের কাছ থেকে তা কেড়ে নেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক ইউপি চেয়ারম্যান। চুড়ান্তভাবে তাকে বহিষ্কার কেন করা হবে না, সেটা জানাতে তাকে ১০০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে তা ফেরত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে।ত্রাণের চাল চুরির সাথে জড়িতদের ক্রসফায়ার দিতে প্রশাসনের নিকট আহবান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একজন সহ-সভাপতি। পর্যবেক্ষকদের মতে ক্রসফায়ার আতংক, এমন একটি আতংক যার একটি পক্ষপাত আছে। সেদিক থেকে তো বটেই, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এধরণের প্রস্তাবনা আরো বিপদ জনক। তবে এধরণের দাবি তোলা একটি বাস্তবতাকে সামনে আনে। সেটা হলো অইনের শাসনে বিশ্বাস না থাকা। ‘করোনাকালীন মানবাধিকার পরিস্থিতি’ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন একদল গবেষক। তারা ত্রাণচুরি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তারা বলছেন যে, ত্রানে অনিয়ম ব্যাপক।১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১২টি জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং সমালোচনার ভিত্তিতে গবেষণাটি করেন আনু মুহাম্মদ (শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), শহিদুল আলম (আলোকচিত্রী), ফরিদা আক্তার (নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী), জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট), রুশাদ ফরিদী (সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সাইদিয়া গুলরুখ (গবেষক ও সাংবাদিক) ও রেজাউর রহমান লেনিন (গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী)।

নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ত্রাণচোররা শুধু ত্রাণ চুরি করে না। তারা সবাই দায়িত্বশীল অবস্থানে আছেন। এখানে তারা যাই পান , সেটাই খাবেন। তারা ত্রাণ খান। অন্য কিছু খান না। এটা তো হতে পারে না। মুজিব বর্ষ চলছে। সেই সময়ে আওয়ামী লীগে থেকেই জাতির এতবড় দুর্যোগে ত্রাণচুরি করে তারা সবথেকে বেশি হুমকিতে ঠেলেছে আওয়ামী লীগকেই। ত্রাণচোরেরা কারো বন্ধু নয়। তারা গণশত্রু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দলীয় পরিচয় বিচারে ত্রাণ দেবেন না। ত্রাণচোরদের শাস্তি পেতে হবে। এখন দেখার বিষয়, কারা এটা তামিল করছেন না। করলেও কতোটা করছেন। মানুষ তাতে স্বস্তি পাচ্ছে কিনা।

সূত্রঃ মানবজমিন 

Bootstrap Image Preview