চলচ্চিত্র, সিনেমা, ছায়াছবি, ফিল্ম- হরেক নামের এই রুপালি জগত সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। মঞ্চ, টেলিভিশন, ইউটিউব যে যেখানেই কাজ করুক না কেন, সবারই মনের কোন এক কোণে ছোট্ট আশা থাকে, নিজেকে একবারের জন্য রুপালি পর্দায় দেখতে যেন পায়। বন্ধু বান্ধবের মধ্যে কাউকে একদিন দেখতে সুন্দর লাগলেই আমরা বলে উঠি, কিরে আজ তোকে সিনেমার অমুক নায়কের মত লাগছে। প্রিয়তমাকে সিনেমার নায়িকা হিসেবে সম্বোধন করাটাও কিন্তু নতুন কিছু নয়। সিনেমা নিয়ে যখন মানুষের হৃদয়ে এত আবেগ, তবে আমাদের সিনেমা হল কেন জনশূন্য?
হ্যাঁ, কথা বলছি বাংলা সিনেমার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে। দুই যুগ আগেও যেখানে সারাদেশে প্রায় ১৪০০ সিনেমা হল ছিল, কালের বিবর্তনে তার সংখ্যা এখন প্রায় ২৫০ তে এসে ঠেকেছে। বছর বছর সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা কমছে; একের পর এক প্রযোজকরা সিনেমায় অর্থ লগ্নি করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন; সিনেমা হলগুলো ভেঙে সেখানে শপিং মল নির্মাণ হচ্ছে। মোটকথা চলচ্চিত্র শিল্প এখন লাইফ সাপোর্টে আছে, যে কোন সময় নিভে যেতে পারে জীবনের বাতি।
ফিল্ম বিষয়ে নিজের শিক্ষাজীবনের চারটি বছর অতিবাহিত করার সুবাদে এই বিষয়ে অনেক সময় দেওয়া পরেছে। নিজের দেশ বাদেও যেমন দেখেছি জেমস ক্যামেরুন, স্পিলবারগ, ট্যারেনটিনোদের মনোমুগ্ধকর কাজ, তেমনি দেখেছি দক্ষিণ ভারতীয় পুরোদস্তুর মাসালা মুভির ম্যাজিক। এরপর ভাবলাম আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সমস্যা আছে সেকথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা তো কমবেশি সব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই থাকে। কিন্তু ওরা কিভাবে সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করছে যেটা আমরা পারছি না।
হলিউড-বলিউডদের সাথে তুলনায় যেতে চাই না; ওরা রেসের সামনের দিকের ঘোড়া। তুলনা করব ভারতের মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ‘মলিউডের’ সাথে, যাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি ক্ষুদ্র, কিন্তু কর্মের ছাপ বেশ গভীর।
কারণ হিসেবে প্রথমেই যেই ব্যপারটা আমার মাথায় ঘুরপাক খায় তা হল আমাদের কিছু নির্মাতারা দর্শকদের চাহিদা বুঝতে চায় না। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে ইংলিশ, হিন্দি, তামিল থেকে শুরু করে ইরানী, স্প্যানিশ, কোরিয়ান ফিল্মও দেখে। বুঝতে হবে এখনকার যুগ এবং দর্শক ডিজিটাল! আর এই ডিজিটাল যুগে এসে যখন আপনি কোন দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার সিন ফ্রেম টু ফ্রেম চুরি করে নিজের সিনেমায় চালিয়ে দিবেন, তখন এই ডিজিটাল দর্শকের কাছে ধরা তো খেতেই হবে। নির্মাতাদের বুঝা উচিত, দর্শক ভাল গল্প চায়, ভাল গল্পের সুন্দর উপস্থাপন চায়। নাহলে কি আর সাবটাইটেল দেখে দেখে কোরিয়ান স্প্যানিশ ফিল্ম দেখে? এখন প্রশ্ন উঠবে ভাল গল্প দিয়ে ভাল উপস্থাপন করতে যে ভাল পরিমাণের টাকা লাগবে সেই ভাল টাকাটা পাবে কোথায়? এবার আসি মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রসঙ্গে; কারণ ‘ভাল টাকার’ উত্তরটা তো সেখানেই লুকিয়ে আছে।
২০১৫ সালে মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রির এক অনবদ্য সৃষ্টি ‘প্রেমাম’। সিনেমাটি মুক্তির পরপরই বক্স অফিসে ঝড় তুলে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। অথচ সিনেমার বাজেট শুনলে অবাক হবেন; মাত্র ৪ কোটি টাকা! হ্যাঁ, মাত্র ৪ কোটি টাকার সিনেমা ৬০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। এবার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মারাঠি সিনেমার ইতিহাসের সবথেকে ব্যবসাসফল সিনেমা হচ্ছে ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাইরাট’। প্রেমামের মত এই মুভির বাজেটও ছিল মাত্র ৪ কোটি অথচ ব্যবসা করেছিল প্রায় ১১০ কোটি টাকার মত!
আমাদের দেশেও তো ২-৪ কোটি টাকা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। তবে আমাদের সিনেমা ৬০ কোটি তো দূরে থাক, লগ্নিকৃত অর্থ তুলতেই কেন হিমশিম খাচ্ছে? কারণটা হচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং দর্শকদের মাঝে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিছু নির্মাতারা ভাবছে যেন তেন ভাবে একটা গল্প নিয়ে একটু নাচ গান যোগ করলেই ব্যাস হয়ে গেল সিনেমা। হ্যাঁ নাচ গান অবশ্যই জরুরি(ক্ষেত্রবিশেষে), তবে এর সাথে বর্তমানে সবথেকে বেশি যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে একটি ভাল গল্প। এই ভাল গল্পের কারনেই কিন্তু মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছে; প্রেমাম, ব্যাঙ্গালর ডেইজ, চার্লির মত সিনেমা উপহার দিয়েছে। আর এই ভাল গল্পের অভাবেই আমাদের সিনেমাগুলো বক্স অফিসে একের পর এক মুখ থুবড়ে পরছে।
বিগত বছর পাঁচেক ধরে ভারতে বায়োপিকের জোয়ার বইছে। ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে শুরু করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-একের পর এক বায়োপিক তৈরি হয়েই চলছে। কারণ হচ্ছে ভারতীয় দর্শকদের কাছে বর্তমানে বায়োপিকের চাহিদা প্রচুর। আর নির্মাতারাও দর্শকদের খোরাক মিটিয়েই যাচ্ছে। বলিউডের সাথে তুলনায় যাবনা বলা সত্ত্বেও তুলনা করার কারণ হচ্ছে দর্শকদের চাহিদা বুঝতে পারাটা যে কতটা জরুরি সেটা তুলে ধরা।
আমাদের দেশের কিছু নির্মাতা ও কলাকুশলীদের বড় একটি সমস্যা হল আমাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। ছোটবেলা থেকেই আমরা খুব পরিচিত একটি প্রবাদ বাক্য শুনে অভ্যস্ত, আমরা বাঙালি কখনই আরেক বাঙালির ভাল সহ্য করতে পারি না। কোন বাঙালি এক সিঁড়ি উপরে উঠলে আমরা সবাই মিলে তাকে টেনে হিঁচড়ে দশ সিঁড়ি নিচে নামাই। বাংলা সিনেমার করুণ দশার মুখ্য কারণও কিন্তু এটাই। আমরা বাঙালিরা কখনই একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করায় বিশ্বাসী না।
একজন ফিল্মমেকার তার সব স্বপ্নকে পুঁজি করে ঝুঁকির চিন্তা মাথায় রেখেই সিনেমা তৈরির যুদ্ধে নামে। সিনেমা তৈরির যুদ্ধে যখন সফল হয় তখন বাধ সাধে মহামান্য সেন্সর বোর্ড। এরা যেন খড়ের গাদায় সুই খুঁজতে ওস্তাদ। কোন না কোন ভুল তারা ঠিকই খুঁজে পায়। ফলাফল, সিনেমার রিলিজ আটকে যায়। ধীরে ধীরে সিনেমাটা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। বিগত কয়েক বছরে এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটেছে। ভাবতে পারেন আমি সেন্সর বোর্ডের বিরুদ্ধে। না মশাই, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবছরই যখন নিম্নমানের অশ্লীল এবং নকল সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, তখন সেন্সর বোর্ডের ‘বিশেষ কেঁচি’ কোথায় থাকে!
তবে এই ধসের চোরাবালি থেকে বাঁচার উপায় কি? আমার কাছে মনে হয়, এখন এই ডুবে যাওয়া শিল্পকে বাঁচানোর মালিক একজনই-দেশের সরকার। যে হারে সিনেমা হল কমছে তাতে করে এমন দিন বেশি দূরে নেই যেদিন সারা দেশে গোটা পাঁচেক মাল্টিপ্লেক্সই থাকবে শুধু। একমাত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাই পারে এই ডুবন্ত তরীকে আবারও জলে ভাসাতে। প্রথম ধাপে যদি সব বিভাগীয় শহরগুলোতেও একটি করে মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণ করে দেয়, তাহলেও কিছুটা হলে প্রযোজক নির্মাতারা লাভবান হবেন, দর্শকদের কাছে সিনেমা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ পাবেন। একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কিন্তু লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেই মাল্টিপ্লেক্স ব্যবসা চালাবে। অর্থাৎ ব্যবসা ভাল চলছেনা আর ওমনি মাল্টিপ্লেক্স ব্যবসা বন্ধ করে দিবে। কিন্তু সরকারের ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির ঝুঁকিটা অনেকাংশেই কম। তাই এই মুহূর্তে সরকারের এগিয়ে আশাটাই বেশি জরুরি।
এছাড়াও, একটি ভাল গল্পের কোন বিকল্প নেই। গল্পের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সিনেমার ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেদের দেশের গুণী লেখকদেরকে কাজে লাগানো উচিত। আমাদের দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গল্প; আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের হাজারো না বলা গল্প। এই গল্পগুলোকে খুঁজে বের করে লেখকদের হাতে তুলে দিতে হবে। তাই লেখকদের যথার্থ মূল্যায়ন করাটাও অনেক বেশি প্রয়োজন।
সবশেষে, সিনেমাশিল্পের সাথে জড়িত সকলেরই মিলেমিশে কাজ করাটা অনেক বেশি জরুরি। একে অপরকে যথেষ্ট পরিমাণ সহযোগিতা করা এবং নতুনদেরকে কাজের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দেওয়াটাও জরুরি। তরুণ নির্মাতা-কলাকুশলীদের কাছেই নতুনত্ব আনার ক্ষমতা থাকে। তাই নতুনদেরকে স্বাগত জানানো অত্যাবশ্যকীয়।
পরিশেষে, আমরা সবাই চাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একদিন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে পৌঁছাক। অস্কার, কানসের পর্দায় বাংলা চলচ্চিত্রের জয়জয়কার হোক। স্বপ্ন কতটুকু সফল হবে তা জানিনা,তবে স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি।