মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তাঁকে "শহীদ" বলে বর্ণনা করেছেন।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) সকালে মুরসির পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের উপস্থিতিতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কায়রোতে দাফন করা হয়।
মুরসির স্ত্রী নাগলা টুইটারে বলেন, আমরা আমার স্বামী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে শহীদ হিসাবে বিবেচনা করি।
তিনি বলেন, দক্ষিণ কায়রোয় তোরা জেলের হাসপাতালে মুরসির গোসল দেয়া হয় এবং একই কারাগারের মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি আরও বলেন, কেবলমাত্র তার পরিবারকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রার্থনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং তাকে (পূর্ব কায়রোয়) নাসর সিটির মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ নীল ডেল্টা প্রদেশে মুরসির নিজ শহরে তাকে দাফন করতে অস্বীকার করেছিল।
গত ১৭ জুন আদালতকক্ষে শুনানি চলার সময় হঠাৎ অচেতন হয়ে যাওয়ার পর মারা যান মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মুরসি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভি জানিয়েছে, সোমবার আদালতে মুরসি মৃত্যুবরণ করলেও মৃত্যুর বিষয়টি বেশ অনেকটা সময় গোপন রাখে সিসি প্রশাসন। এমনকি মুরসির মৃত্যুর সঠিক সময়ও প্রকাশ করা হয়নি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, সোমবার আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর একপর্যায়ে ৬৭ বছর বয়সী সাবেক এই প্রেসিডেন্ট জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এর কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
অন্যদিকে বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, আদালতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি পাচারের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার শুনানি চলছিল। একপর্যায়ে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বিচারকের কাছে কথা বলার অনুমতি চাইলে তাকে কথা বলতে অনুমতি দেয়া হয়। এ সময় ২০ মিনিট বক্তব্য রাখেন ড. মোহাম্মদ মুরসি। বক্তব্য দেয়ার মাঝেই বুকে ব্যথা অনুভব করেন মুরসি।
একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এ সময় দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি।
এদিকে মুরসি কারাগারে অকালে মারা যেতে পারেন বলে আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা আগে থেকেই সতর্ক করেছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে কারাবন্দি রাখার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
এদিকে মুরসির মৃত্যুর জন্য দেশটির স্বৈরাশাসনকে দায়ী করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান।
সোমবার ইস্তাম্বুলে টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে এরদোগান বলেন, যারা সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে কারাগারে পাঠিয়েছিল এবং তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল ইতিহাস কখনও সেই স্বৈরশাসককে ক্ষমা করবে না।
এদিকে, টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে মুরসির মৃত্যুকে শহীদের সাথে তুলনা করেন এরদোগান। তিনি বলেন, ‘আমাদের চোখে মুরসি হলেন একজন শহীদ। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
মিসরের ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে বলেও অভিযোগ করেন এরদোগান। এদিকে মুরসির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসুগ্লু বলেছেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু তার স্মৃতি কখনো মুছে যাবে না।
কে এই মুরসি?
উত্তর মিসরের আল-আদওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক।
শৈশবে গাধার পিঠে করে স্কুলে যেতেন তিনি। ১৯৭৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আর ১৯৭৮ সালে তিনি ধাতুবিজ্ঞানে এমএ পাশ করেন।
সে বছর ১৭ বছর বয়সী চাচাতো বোন নাগলা মাহমুদকে বিয়ে করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে একটি সাময়িকীতে দেয়া সাক্ষাতকারে নাগলা বলেন, ঘরের টুকিটাকি কাজ ও রান্নাবান্নায় তাকে সহায়তা করতেন মুরসি।
তিনি বলেন, মুরসির সবকিছুকে তিনি ভালোবাসেন। আমাদের ঝগড়া কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হতো না।
মিসরের একটি টেলিভিশনকে চ্যানেলকে মুরসি বলেন, নাগলাকে বিয়ে ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
১৯৭৯ সালে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন। বেশ কয়েকটি বছর মুরসি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮২ সাল থেকে মিসরের ফেরার আগ পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে মিসরে ফিরে আসেন কোরআনে হাফেজ মুরসি।
জ্যাগাজিগা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাতু প্রকৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এই শিক্ষাবিদ। ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানের অধ্যাপক ছিলেন তিনি।
২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মিসরের পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। ব্রাদারহুডের অধীনে প্রার্থী হওয়া নিষিদ্ধ হওয়ায় তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে করেছিলেন।
২০১১ সালের বিপ্লবের পর ব্রাদ্রারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডাম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুরসি এই সংগঠনের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ২০১২ সালে মুরসির মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালনের এক বছরের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতা হারান।
২০১৬ সালে তাকে কায়রোর কুখ্যাত তোরা কারাগারে স্থানাস্তর করা হয়েছে। প্রায় ছয় বছর নির্জন কারাবাসে ছিলেন তিনি। সোমবার আদালতে বিচার শুনানির ফাঁকে কারাকক্ষের খাঁচার চত্বরে পড়ে যান মুরসি। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।