Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কান্না, চিৎকার, রক্তে ইয়াসমিনের বিভৎস অভিজ্ঞতা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০১৯, ০৬:২৮ PM
আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৯, ০৬:২৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে সোমবার সন্ধ্যার এক অতর্কিত হামলায় কেড়ে নিয়েছে দুই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সাতজনের প্রাণ। এই ঘটনায় নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশকে। যদিও দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বিবাদমান পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে হানাহানি আর হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু রাস্তার ওপর অ্যামবুশ করে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের এভাবে হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন।

সোমবার (১৮ মার্চ) দেশের বিভিন্ন স্থানের ১১৫টি উপজেলার সঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলাতেও ভোট হয়। তবে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে সকালেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরপর সন্ধ্যায় ঘটে ওই হত্যাকাণ্ড।

নিহতরা হলেন- পোলিং অফিসার আমির হোসেন ও আবু তৈয়ব, আনসার-ভিডিপি সদস্য মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম এবং মন্টু চাকমা।

সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারের কাছে। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও চোখের সামনে সহকর্মীদের খুন হতে দেখার পর স্বাভাবিক হতে পারছেন না এই শিক্ষিকা। 

পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ইয়াসমিনকে পাঠানো হয়েছিল বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে রবিবার দুপুরেই তারা কেন্দ্রে পোঁছে যান। সোমবার সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। 

ইয়াসমিন আক্তার বলেন, পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে যাচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো গণ্ডগোল ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হল। এরপর আমরা গণনাও শেষ করলাম।

তিন বলেন, ওই কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা অনুসারী অংশের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তার প্রতীক ছিল ঘোড়া। সুদর্শনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার অনুসারী অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের গত মেয়াদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা ভোটের সকালেই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে তার প্রতীক ছিল দোয়াত কলম।

শিক্ষিকা ইয়াসমিন জানান, ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ওই গাড়িতে ছিলেন।

তিনি তার বর্ণনায় বলেন, আমাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেশে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন। আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করলো। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িটা।

ইয়াসমিন জানান, তাদের গাড়িগুলো নয়মাইল এলাকায় পৌঁছানোমাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি শুরু হয়। কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। এ এক বিভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত...।

তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে মারা ছয়জনের মৃত্যু হয়। রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন।

‘সারা দিন আমরা একসাথে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক…,’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন আক্তার।

তিনি বলেন, এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছে। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাইতো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হল?

‘কবে বন্ধ হবে এইসব বর্বরতা। আর কত লাশ পড়বে পাহাড়ে? এর মধ্যে কীভাবে আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করব?’

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে করে ইয়াসমিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যে কোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদেরকে নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এরকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরও বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।

Bootstrap Image Preview