Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

মধ্যবিত্তকে জিম্মি করে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘রমরমা ব্যবসা’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০১৯, ০৭:৪৭ PM
আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯, ০৭:৪৭ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার একাংশ ও হাজারীবাগ থানার একাংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৪নং ওয়ার্ড। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এখানে ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে এর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। খোদ থানা শিক্ষা শিক্ষাকর্মকতার কাছেও নেই সঠিক পরিসংখ্যান। মনগড়া নীতিতে চলছে পাঠদান। নানা কৌশলে মধ্যবিত্ত পরিবার হতে শিক্ষার নামে হাতিয়ে নেওয়া মাত্রাতিরিক্ত অর্থ।

৩৪নং ওয়ার্ডের দূর্গা মন্দিদের পাশের দিয়ে পশ্চিম দিকে নেমে গেলেই চোখে পরবে একটি দু'তালা ভবন। গায়ে আলিফ আইডিয়াল পাবলিক স্কুল লেখা। যার নিচের একটি হোটেল, কাঁচা সবজির ও পাখির খাবারের দোকানসহ একাধিক দোকান। প্রথম দর্শনে যে কেউ মনে করবে উপরে দেয়াল লেখনীর মাধ্যমে স্কুলটির প্রচারণা হচ্ছে। কিন্তু ভবনের দ্বিতীয় তলার জরাজীর্ণ পরিবেশেই চলছে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম।

আলিফ আইডিয়াল পাবলিক স্কুলের সরকারি অনুমোদন আছে কি-না জানার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ একাধিক দায়িত্বশীল শিক্ষকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও বিদ্যায়লের কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।

উল্টো বিডিমর্নিং-এর সংবাদকর্মীকে স্কুল অংশের মূল গেট বাইরে বের করে দেওয়া হয় এবং এ সময় হুমকি দেওয়া হয়, যদি বেশি বাড়াবাড়ি করা হয় তাহলে চাঁদাবাজ বলে আটকে রাখবে। ভিতর থেকে তারা আরো জানান, তাদের অনুমতি আসে কি না জানতে হলে 'বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশনে গিয়ে খবর নিতে হবে'।

এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আধা কিলোমিটানের মধ্যে (৪২ জাফরাবাদ) শের-ই-বাংলা আইডিয়াল স্কুল এটার চিত্র আরো ভয়ঙ্কর। একটি ভবনের নিচের তালা ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শ্রেণিকক্ষের পাশে বাড়ির মালিকের জুতার গোডাউন। আর যেখানে প্লে বা শিশুশ্রেণির ক্লাস হচ্ছে। তার পাশেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের থাকার ঘর আর রান্না ঘর। এক কথায় কোনো শিক্ষার পরিবেশ নেই বললে ভুল হবে না।

উপস্থিত অভিবাবকদের সাথে স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয়। ১ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আসলে এই মহল্লায় আমি নতুন এসেছি। বাড়ির কাছে স্কুল দেখে ভর্তি করেছিলাম। ভর্তির সময় বলেছিল আমাদের অতিরিক্ত কোনো শিক্ষক লাগবে না। স্কুলের পড়া স্কুলেই শেষ করিয়ে দিব। কিন্তু ২ মাস যেতে যাতে না যেতেই প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী আমাদের সবাইকে বাধ্য করেছে তার কাছে প্রাইভেট পড়তে। আর না পড়লে বাচ্চার নাম্বার কমিয়ে দেয়।

তিনি আরো বলেন, পরিক্ষার ফলাফল খারাপ হলে সন্তানের মনে কোনো মানষিক চাপ পরতে পাড়ে। এ জন্য এখন বাধ্য হয়ে ৮০০ টাকা দিয়ে ৫ বছরের বাচ্চাকে কোচিং-এ ক্লাস করাচ্ছি ম্যাডামের কাছে।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন অপু বলেন, আপনাকে কে অনুমতি দিয়েছে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তদারকি করার। আপনাদের মত গণমাধ্যম আমরা পকেটে রাখি। আমার ইচ্ছা আমি ও আমার বউ স্কুলে পড়াই। এখানে কোনো অনিয়ম নেই। সরকারি নিয়মে স্কুলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পড়ানো অনুমতি আছে।

কিন্তু সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোচিং ক্লাস হতে আদায়কৃত অর্থের রশিদ ও তহবিল দেখতে চাওয়া হলে তা দেখাতে ব্যথ হন তিনি। এ সময় তিনি কিছু স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভয় দেখিয়ে বলেন, 'এরা আমার স্কুলের দাতা, কোনো প্রশ্ন থাকলে তাদের কাছে যান'।

একটু এগিয়ে গেলে সাকসেস মডেল হাইস্কুল (১৪ জাফরাবাদ)। স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের সাথে কথা বললে যে চিত্র উঠে আসে তা অন্য স্কুলগুলো থেকে একটু ভিন্ন। কিন্তু আরো ভয়ঙ্কর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই বিক্রি হচ্ছে গাইড বই এবং শিক্ষকরা গাইড বই থেকেই ক্লাস নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রূহুল আমীন বিডিমর্নিংকে বলেন, ভাই সরকার যেভাবে শিক্ষা নীতি ও অনিয়ম কানুন সাজিয়েছে, আমি নিজেই তো বুঝি না। ছাত্ররা আর কি বুঝবে। তাই গাইড বই থেকে পড়াতে বাধ্য হচ্ছি।

স্কুল থেকে গাইড বই বিক্রি বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমরা স্কুল থেকে বিক্রি করি না। তবে আমরা একটা লাইব্রেরির সাথে চুক্তি করেছি। তারা স্কুলে এসে বিক্রি করে।

তিনি আর বলেন, ভাই আমাদের ছাত্র আর কয়জন? আলাদাভাবে যদি একটু আয় না করি তাহলে কিভাবে চলবে বলেন।

সরজমিনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, সরকারিভাবে অনুমোদনের বাইরে যেকয়টি স্কুল গড়ে উঠেছে তারা প্রায় সবই অনুমতি দিয়েছে 'বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন' থেকে।

বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে কিসের ভিত্তিতে অনুমোদন দিচ্ছে জানার জন্য 'বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন'র চেয়ারম্যান মো. ফখরুক ইসলামের মুখোমুখি হয় বিডিমর্নিং-এর এই প্রতিবেদক।

এ সময় ফখরুক ইসলাম শিক্ষা মন্ত্রালয় কৃতিক অনুমোদিত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তিনি জানান, তারা আসলে একটি সমিতির মত করে তাদের অ্যাসোসিয়েশন চালাচ্ছেন।

তিনি আরো জানান, নতুন স্কুল যারা করছে তাদের শুধুমাত্র কাগজপত্র করতে হেল্প করছেন তারা। কি কাগজ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আসলে আমাদের কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলোর কোনো সরকারি কাগজ নেই। কিন্তু আমরা আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত করে থানা শিক্ষা অফিসে, জেলা শিক্ষা অফিসে ও শিক্ষা মন্ত্রালয়ে কিছু কাগজ দিয়ে থাকি। আর তারাই সহযোগিতা করে থাকে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল-হোসেন সাথে কথা হয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অর্থ ক্ষাতের অনিয়ম ও পরিবেশগত বিষয়ে।

আকরাম আল-হোসেন বলেন, আসলে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আর একটি অসাধু চক্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ক্ষাতকে ব্যবসায় রূপান্তর করে ফেলেছে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নীতিমালা তৈরি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। নীতিমালার কাজ শেষ হলে আমরা নোটিশ পাঠাবো এবং তার পরেও যারা অনিয়ম করবে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালিত করা হবে।

সরকারি অনুমোদন ছাড়া গড়ে উঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম নিয়ে আকরাম আল-হোসেন বলেন, আসলে এ বিষয়ে আমার তেমন কিছু বলার নেই। কারণ সবার আগে অভিবাবকদের সচেতন হতে হবে। আপনি আমি সবাই জানি কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো মূল লক্ষ্য হচ্ছে টাকা আদায় বা অর্থ উপার্জন করা। তারা সেটা ঠিকই করছে। আমরা আমাদের সন্তানকে কোথায় ভর্তি করবো এ বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে।

স্কুল থেকে অবৈধ গাইড বই বিক্রি নিয়ে একাধিক অভিযান পরিচালনাকারি দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ারের সাথে কথা হয় বিডিমর্নিং-এর এই প্রতিবেদকের।

তিনি বলেন, ১৯৮০ সালের নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইন অনুসারে ও ২০০৮ সালে নির্বাহী আদেশ অনুসারে গাইড ও নোট বই ছাপা ও বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর স্কুল থেকে গাইড বই বিক্রি তো পুরোপুরি বেআইনি। এমন তথ্য আমাদের কাছে ইতিপূর্বে আসেনি এমনটা বলবো না। তবে সঠিক তথ্য প্রমাণের অভাবে আমাদের অভিযান পরিচালনায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে খুব শীঘ্রই আমরা এ বিষয়ের তদন্ত করে অভিযান পরিচালনা করবো।

Bootstrap Image Preview