অনলাইনে নকল স্মার্টফোনের রমরমা বাণিজ্য চলছে। নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে তৈরি নিম্নমানের ভুয়া এবং অবৈধ উপায়ে আনা হ্যান্ডসেটে সয়লাব দেশের স্মার্টফোনের বাজার। এতে সরকার হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব, বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা। অন্যদিকে ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো।
৭ ফেব্রুয়ারি নোকিয়া স্টোর বিডি নামে একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয় নকিয়া ৮.১ মডেলের একটি মোবাইল সেটের বিজ্ঞাপন। এতে লেখা হয়েছে, ৬৫ শতাংশ ছাড়ে নোকিয়া ৮ ফোরজি (নিউ) মোবাইলটি লুফে নিন। এরপর লেখা আছে নোকিয়া ৮.১ ফোরজি (ব্র্যান্ড নিউ)। বর্তমান মূল্য : ৩৯৫০ টাকা মাত্র। অর্ডার করুন- লিখে দুইটি মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে। ১২ মাস মানিব্যাক গ্যারান্টি এবং দুই বছরের ওয়ারেন্টি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশে পৌঁছে দেয়া হয়। ডেলিভারি চার্জ ১৫০ টাকা (কুরিয়ার সার্ভিস)। এরপর লেখা আছে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য : ১৬ মেগাপিক্সেল ডুয়েল ক্যামেরা পেছনে, সামনে ক্যামেরা ৮ মেগাপিক্সেল।
১২৮ জিবি ইন্টারন্যাল মেমরি, ৪ জিবি র্যাম। এভাবে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে ফোনটির। শুধু এ মডেলটিই নয়, নকিয়া ৭.১ প্লাস, নোকিয়া নাইনইডিইজিসহ বিভিন্ন ফোনের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে এখানে। এসব ফোনে ৬৫ থেকে ৭০ পারসেন্ট ছাড় দেখিয়ে লোভনীয় অফার দেয়া হয়েছে।
নকিয়া বিডি স্টোরে নকিয়া ৮.১ মডেলের ফোনটির দাম ৬৫ পারসেন্ট ছাড়ে ৩৯৫০ টাকা, ৭০ পারসেন্ট ছাড়ে নকিয়া ৭.১ প্লাস ফোনটি ৭৫০ টাকা, নোকিয়া নাইনইডিইজি ফোনটি ৪২০০ টাকা বিক্রয়মূল্য লেখা হয়েছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নোকিয়া ৮.১ ফোনসেটটির বাজারমূল্য ৪৪ হাজার টাকা, নকিয়া ৭.১ প্লাস ফোনটির মূল্য ৩৪ হাজার ৯৯০ টাকা। নোকিয়া নাইনইডিইজি ফোনটির দাম ৫২ হাজার ৮০০ টাকা।
মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা রিফাত ফেসবুকে নোকিয়া স্টোর বিডির বিজ্ঞাপন দেখে অর্ডার দেন নোকিয়া ৮.১ ফোরজি ফোন সেটটির জন্য। পরদিন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছে যায় ফোন সেটটি। কন্ডিশনে বিল পরিশোধ করেন রিফাত। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রথমে দেখে বুঝে উঠতে পারিনি ফোনটি নকল। তবে ব্যবহার করে যা বুঝেছি, এই ফোনসেটটি কেউ ফ্রি দিলেও আমি নিতাম না। আমি এ ফোনসেটটি কিনে প্রতারিত হয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু নকিয়াই নয়, স্যামসাং, হুয়াওয়ে, এমআইসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল ফোন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় পেজ ও গ্রুপ খুলে কম মূল্যে লোভনীয় অফার দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। নকিয়া স্টোর বিডি ডট নিউ মোবাইল বিডি, মোবাইল শপ, নিউ মোবাইল অনলাইনসহ নানা নামে পেজ খুলে অনলাইন ডেলিভারির জন্য ফোন নম্বর দিয়ে জমজমাট ব্যবসা চালাচ্ছে একটি চক্র। আর এসব নকল মোবাইল ফোনের জোগান দিচ্ছে নগরীর বেশ কয়েকটি মার্কেটের কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এসব পেজ কয়েকদিন পর পর বন্ধ করে দিয়ে আবার নতুন পেজ খুলে প্রতারকচক্র। এদের নেই কোনো অফিস বা ঠিকানা। সবকিছু আড়াল রেখে এরা শুধু কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে পণ্য পাঠাচ্ছে। বেশির ভাগ প্রতারণার অভিযোগ এসেছে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে। ‘অরিজিনাল’, আসল, মাস্টার কপি-নানা শব্দে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে প্রতারকচক্র। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মাস্টার কপি বা ক্লোন কপি বিক্রি নিষিদ্ধ।
মাস্টার কপি ফোন হচ্ছে- উৎপাদনের সময় ত্রুটির কারণে বাজারজাত না করা বাতিল হ্যান্ডসেট। এই হ্যান্ডসেটগুলোই চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম থেকে ৫০ শতাংশ কিংবা তারও কম দামে বিক্রি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনলাইনে যেসব হ্যান্ডসেট মাস্টার কপি নামে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো মাস্টার কপি নয়। এগুলো চীনে তৈরি অত্যন্ত নিুমানের ক্লোন বা নকল হ্যান্ডসেট। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অখ্যাত কোনো চায়না ব্র্যান্ডের নাম দিয়ে এগুলো আমদানি করা হয়। পরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে মাস্টার কপি হিসেবে বিক্রি করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেসবুকে নকল ফোন বেচাকেনার ১০টির বেশি গ্রুপ ও পেজ রয়েছে। ইস্টার্ন প্লাজা, মোতালেব প্লাজা, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী এসব নকল মোবাইল সেট বিক্রি করে। আর সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা তাদের কাছ থেকে এসব ফোনসেট সংগ্রহ করে অনলাইনের মাধ্যমে ক্রেতাদের হাতে তুলে দেয়। প্রায়ই এসব মার্কেটে অভিযান চালিয়ে নকল ফোনসেট জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ৩১ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর ইস্টার্ন প্লাজা ও মোতালিব প্লাজায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০০ নকল মোবাইল ফোনসেট জব্দ করা হয়। পাশাপাশি প্রায় ১৮ লাখ টাকা জরিমানা ও ৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বলেন, শুধু ই-শপিং নয়, যে কোনো প্রতারণার অভিযোগ পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ থাকলে পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।
জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল যুগান্তরকে বলেন, গুটিকয়েক লোক নকল পণ্য দিচ্ছে। কিন্তু এর সংখ্যা খুব কম। ই-ক্যাব অনেক আগে থেকেই এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমাদের দেশে ই-কমার্সের পরিধি বেড়েছে। এজন্য জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা তৈরি হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ই-কমার্স সেল গঠন করা হবে। ওই সেল সবকিছুর নজরদারি করবে। তিনি বলেন, প্রতারকদের খপ্পর থেকে মুক্ত থাকতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। জনসচেতনতা তৈরিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ক্রেতাদের উচিত বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ থেকে পণ্য ক্রয় করা। তাহলে প্রতারণার ফাঁদগুলো এড়ানো সম্ভব।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মঞ্জুর মোরশেদ শাহরিয়ার বলেন, কয়েকটি অনলাইন শপের বিরুদ্ধে আমরা বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে অনলাইনে কেনাকাটায় ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে।