Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৬ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

৯৪২ ধর্ষণের সাক্ষী হয়ে ১৮'র বিদায়; ৫২ ধর্ষণ দিয়ে নতুন বছরের পথচলা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০১:৪৯ PM
আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৬:০৩ PM

bdmorning Image Preview


“সময়টা গত বছরের ডিসেম্বরের ১৭। আনুমানিক সকাল ১০ টা কি সোয়া দশটা হবে। কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও দেখে উত্তেজিত অবস্থায় তিন বছরের শিশুকে একটি নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় মেহেরাজ হোসেন তুষার(২০)। এ সময় শিশুটি চিৎকার শুরু করলে লোক জমায়েতের ভয়ে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় শিশুটিকে। পরে লাশ ওই ভবনেরই একটি রুমে সিমেন্টের বস্তার নিচে গুম করে রাখে। পরদিন স্থানীয়রা সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধার করে। ধর্ষণ চেষ্টা ও হত্যার পরের দিন ঐ শিশুর জানাযাতেও অংশ নেয় ঘাতক তুষার। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে তুষার। আর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই সহিদার রহমান।“

“গৃহবধূর স্বামী বরিশালে একটি ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। স্বামী বাড়িতে না থাকার সুযোগে প্রতিবেশী মনিরুল গৃহবধূকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। ২৭ জানুয়ারি রোববার ভোররাতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে গৃহবধূর ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে মনিরুল। পরে দুই সন্তানকে বলে, ‘আওয়াজ করলে খুন করে ফেলবো।‘ এভাবে হত্যার ভয় দেখিয়ে আটকে রাখে তাদের। পরে তাদের মাকে ধর্ষণ করে পালিয়ে যায় মনিরুল। গুরুতর অবস্থায় গৃহবধূকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে স্বজনরা। বর্তমানে সদর হাসপাতালে গৃহবধূ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন, থানা পুলিশের ওসি মেহেদী রাসেল।“

“২৭ জানুয়ারির একই দিনে সাভারের আশুলিয়ায় নয় বছর বয়সী এক মাদরাসাছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে মসজিদের এক ইমাম এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ রিজাউল হক দিপু বলেন, মক্তব পড়া শেষে ওই ছাত্রীকে কৌশলে ইমাম সাহেব নিজের ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনে ঘটনার ভিডিও করে বিষয়টি কাউকে জানালে তাকে হত্যা করে লাশ গুম করারও হুমকি দেন। তার পরও ওই ছাত্রী বাসায় গিয়ে বিষয়টি তার বাবা মাকে জানায়। এ ঘটনার খবর পেয়ে রাতেই আশুলিয়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ঘটনার পর দোসাইদ এলাকার কিছু নামধারী দালালের সহযোগিতায় ধর্ষণকারী ওই ইমাম পালিয়ে গেছেন। তাকে ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে।“

“চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি। চারদিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা শুরু। অথচ আচমকা এক বিভীষিকাময় ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে। পরিত্যক্ত ভবনের ছাদে এই পরীক্ষার্থীকে পালাক্রমে তিনজন এই পরীক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে। খুলনার ফুলতলা উপজেলায় এই ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (আরসিডি) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু।“

“রাজবাড়ী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্বপন কুমার মজুমদার ঘটনা নিশ্চিত করে জানান, প্রায় ৪ মাস আগে সুজন খার সঙ্গে ওই ছাত্রীর পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সম্পর্কের জেরে ২৯ জানুয়ারি সোমবার বিকেলে সুজন মেয়েটিকে জেলা শহরের পৌর ড্রাইআইস ফ্যাক্টরি এলাকার একটি পরিত্যক্ত মেসে নিয়ে যায়। সেখানে বন্ধুদের নিয়ে ওই মেয়েকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ সময় মেয়েটির চিৎকার শুনে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়।“

এইসব ঘটনা সবই পত্রিকার পাতা থেকে নেয়া। যা প্রতিদিনই আমাদের সামনে আসছে। তবে প্রতিদিন একটি কিংবা দুটি করে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা হয়তো এতোদিনে আমদের সয়ে গেছে, তাই ভাবার মধ্যে পরে না। কিন্তু এই ঘটোনাগুলো যখন একত্রে সাজানোর চেষ্টা করা হয় তখন যে চিত্র আসে তখন তার ভয়াবহতা সম্পর্কে আন্দাজ করা মুশকিল হয়ে যায়। দুই বছরের শিশু, দুই সন্তানের মা, এসএসসি পরীক্ষার্থী, মাদরাসায় শিক্ষার্থী, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীকে আসলে রেহায় পাচ্ছে এই ভয়ানক থাবা থেকে! আর তার পরের সিরিয়ালে কি আমি কিংবা আপনি কিংবা আমাদের কেউ? এই একটি প্রশ্নই কেবল রয়ে যায়!

চলতি বছর শুধু জানুয়ারি মাসে দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

তাছাড়া লিখিত বক্তব্যে আরো জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৯৪২টি, তর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৮২ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৮ জনকে, শ্লীলতাহানীর শিকার হয়েছে ৭১ জন, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৪৬ জন।

এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ১৯ জন তন্মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৭৩ জন, তন্মধ্যে অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১৪৫টি। নারী ও শিশু পাচার করা হয়েছে ৪১ জন, তন্মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে ১৫ জনকে। ৪৮৮ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ৩৯ জনকে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২১২ জন নারী এদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১০২ জনকে।

গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৭ জন, তন্মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৫৮ জনকে এবং নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ৪ জন। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ১৭১ জনকে, তন্মধ্যে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৪ জন। ফতোয়ার শিকার হয়েছে ১২ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারনে ৩০৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং আরত্ত আন্তহত্যার চেষ্টা করেছে ১৮ জন, আত্মহত্যায় প্ররোচনার শিকার ৪৭ জন এবং ৩৭৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

বাল্যবিয়ের সংক্রন্ত ঘটনা ঘটেছে ১৯৩টি, তার মধ্যে ৫২টি বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রতিরোধ করা হয়েছে ১৪১টি। পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯ জন। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ২৮১ জনকে। জোড়পূর্বক বিয়ের শিকার ২১ জন। এ ছাড়া অন্যান্যরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাব, সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা কারণে এসব ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। কিন্তু সম্প্রতি ধর্ষণে অভিযুক্ত কয়েকজন ব্যক্তির গলায় চিরকুট ঝোলানো অবস্থায় মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে সেরকম বিচার বহির্ভূত হত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়। অপরাধী যেই হোক বিচার বহি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।‘

মানবধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরাও মনে হয়না এতোটা নৃশংশভাবে নারী-শিশুদের ধর্ষণ করেছে। তাহলে আমরা স্বাধীনতা লাভ করে পেলাম টা কি? জন্তু বললেও ভুল হবে, কারণ এখনকার সমাজে নারীরা জন্তুদের থেকেও রেহায় পায়, কিন্তু মানুষের থেকে পায় না। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী করবো আইনী ব্যবস্থা আর সামাজিক মূল্যবোধকে। একজন ব্যক্তির মূল্যবোধ যদি ঠিক থাকে তাহলে সে ধর্ষণের মতো ভয়ানক অপরাধ করবেই না। আর যদি সে অপরাধ সংগঠিত না হয় তাহলে আইনী ব্যবস্থারও প্রয়োজন হয়না। তবে অপরাধ তো থেমে থাকার বিষয় না, তা হচ্ছে, হবেই। সেক্ষেত্রে আইনের সঠিক ব্যবহার আর সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে পারলেই এই ব্যভিচার সমাজ থেকে বন্ধ করা সম্ভব।‘

Bootstrap Image Preview