Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

বেনাপোল বন্দরের রাজস্ব ঘাটতি ৬০৪ কোটি!

শহিদুল ইসলাম, বেনাপোল প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৭:৩৪ PM
আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৯:০৮ PM

bdmorning Image Preview


দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল বন্দরের রাজস্ব ঘাটতি দিনদিন বেড়েই চলছে। ভারতের পেট্রাপোলের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বন্দর-কাস্টমসের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কর্মকতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এরই মধ্যে নানা রকম প্রতিবন্ধকতায় গেল বছর (২০১৮) মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে সপ্তাহে সাতদিনে ২৪ ঘণ্টার বাণিজ্য সেবা। এতে সরকারের যেমন রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়েছে, তেমনি লোকসানও গুণছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে গতিশীলতা বাড়াতে এখানকার বাণিজ্যে জড়িত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরস্পরের সমন্বয়, বৈধ সুবিধা দেওয়া ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। আর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে তারা সমন্বয় করে কাজ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানা যায়, দেশের ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩ বন্দরের অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। ১৯৭২ সাল থেকে এ পথে ভারতের সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। যা থেকে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে শুরু থেকেই এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বন্দরে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা আর ব্যবসায়িক হয়রানির কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না বললেই চলে।

গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এসময় ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আদায় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ঘাটিত রয়েছে ৬০৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত বছর বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল ১৫২ দিন। এর মধ্যে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাস্টমসের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বিজিবির দ্বন্দ্ব, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলন আর বন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাণিজ্য বন্ধ ছিল ২৬ দিন এবং সরকারি ছুটিতে বন্ধ ছিল ১২৬ দিন। এতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় সরকারের ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। আর ব্যবসায়ীদের লোকশান হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সহ সভাপতি আমিনুল হক বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের অনিয়মের কারণে বার বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এখনও সাধারণ পণ্যের ঘোষণা দিয়ে কেমিক্যাল পণ্য খালাস করা হচ্ছে। বাণিজ্যে গতিশীলতা ফেরাতে গত বছরে সপ্তাহে ৭ দিনে ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্যিক সেবা শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সপ্তাহে ৬ দিনে ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্য চলছে। এছাড়া সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটিতে সব ক'দিন বাণিজ্য বন্ধ থাকছে। ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্য সচল রাখতে বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল বৃদ্ধি ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় দরকার। বিশেষ করে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের সহযোগিতা প্রয়োজন। তারা সহযোগিতা না করলে কোনো ভাবে ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্য সচল রাখা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সব বন্দরে আমদানি পণ্যের উপর রাজস্ব পরিশোধের নিয়ম এক হতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যের উপর রাজস্ব ৪ ডলার বেনাপোল বন্দরে ওই একই পণ্যের উপর সাড়ে ৪ ডলার শুল্ক আদায় করা হচ্ছে। বন্দরের ধারণ ক্ষমতা ৩৮ হাজার মে. টন, কিন্তু এখানে সব সময় পণ্য থাকে প্রায় দেড় লাখ মে. টন। জায়গার অভাবে পণ্য খালাস করতে না পেরে ভারতীয় ট্রাক বন্দরে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে মূল্যবান পণ্য সামগ্রী পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বৈধ সুবিধা পেলে এ বন্দর থেকে বর্তমানে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে তখন তার দ্বিগুণ আয় হবে।

ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট সাব কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, অবকাঠামোগত সমস্যায় এ পথে (বিবিআইএন) চার দেশের মধ্যে বাণিজ্যের উদ্বোধন হলেও এখন পর্যন্ত পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হয়নি। যে বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ করে সেসব বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া বেনাপোল বন্দরে আমদানি পণ্যের মান পরীক্ষা নিয়ে কিছু জটিলতা আছে যা অন্য বন্দরে নাই। এতে সরকারের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না।

আমদাদানিকারক ইদ্রিস আলী বলেন, আমদানি পণ্য কাস্টমস কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুনিদিষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকলেও আবার বিজিবি সদস্যরা তা আটক করেছে। সেখানে ৪/৫ দিন পণ্য চালান আটকে থাকছে। বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজিবি আর কাস্টমসের মধ্যে পরস্পরের সমন্বয়ের অভাবে এ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে কেবল লোকসান গুণছেন ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে তারা অন্য বন্দর দিয়ে আমদানি করছেন। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে।

বেনাপোল কাস্টমস হাউজের ডেপুটি কমিশনার জাকির হোসেন জানান, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ার কিছু কারণ আমরা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছি। আগামীতে সেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য থাকবে। এসময় তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

বেনাপোল বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) প্রদোষ কান্তি দাস জানান, তিনি বন্দরে নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। আগে অবশ্য কিছুটা অব্যবস্থাপনা ছিল। তিনি যোগদানের পর বন্দরে অবৈধ প্রবেশ নিষেধ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছেন। বাণিজ্যে গতিশীলতা ফেরাতে ইতিমধ্যে স্বল্প পরিসরে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ আরো বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। 

 

Bootstrap Image Preview