Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

উত্তরবঙ্গের মাটির নিচে সোনা–রুপা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ০৮:৫৯ PM
আপডেট: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ০৮:৫৯ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


অতীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভিত্তিশিলায় (base rock) সোনা, রুপা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের উপস্থিতি আছে বলে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু সেগুলো মূলত শোনা কথা, কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে এ বিষয়ে তথ্য–উপাত্তভিত্তিক কোনো লেখা প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়নি। সংবাদমাধ্যমেও বিস্তারিত সংবাদ আসেনি।

প্রকৃতপক্ষে, পর্যাপ্ত নির্ভরযোগ্য আলামত বা তথ্য–উপাত্ত ছাড়া ভূ-অভ্যন্তরে অথবা ভিত্তিশিলায় কোনো নির্দিষ্ট খনিজের মজুত রয়েছে—এমন বক্তব্য বিভ্রান্তিকর ও অগ্রহণযোগ। কোনো অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশদ গবেষণার পরেই শুধু সোনা, রুপা বা অন্যান্য খনিজ পদার্থের উপস্থিতি, বিস্তৃতি ও ভূতাত্ত্বিক উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। গবেষণায় কোনো খনিজের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই শুধু তার মজুত নির্ণয়ের প্রশ্নটি আসে। মজুত নির্ণয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একাধিক প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি আছে। যেমন জয়েন্ট রিজার্ভ ওর এস্টিমেশন কমিটি (জেওআরসি), প্যান ইউরোপিয়ান রিজার্ভস অ্যান্ড রিসোর্সেস রিপোর্টিং কমিটি কোড (পিইআরসি) সম্ভাবনাময় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছক করে নির্দিষ্ট ঘনত্বে একের পর এক কূপ খনন করে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কোনো খনিজ পদার্থের সম্ভাব্য মজুত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে পাললিক শিলাস্তরের নিচে রূপান্তরিত জমাটবদ্ধ আগ্নেয় শিলাস্তরটি ভিত্তিশিলা অথবা কঠিন শিলা নামে পরিচিত। দেশের অধিকাংশ এলাকায় এই শিলাস্তর ভূস্তরের অনেক গভীরে অবস্থিত; তবে উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে তা কয়েক শ মিটার থেকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরে অবস্থিত। সবচেয়ে কম গভীরতায় (১২৮ মিটার) যে ভিত্তিশিলার স্তরটি রয়েছে, সেটি দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায়। সেখানেই দেশের একমাত্র কঠিন শিলার ভূগর্ভস্থ খনি। সেই খনি থেকে ডায়োরাইট, টোনালাইট, গ্র্যানোডায়োরাইট ইত্যাদি কঠিন শিলা তোলা হচ্ছে। এগুলো প্রধানত রাস্তাঘাট, সেতু, ইমারত ইত্যাদির নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয়।

ভূগর্ভে গলিত আগ্নেয় শিলাপ্রবাহের সঙ্গে অনুকূল অবস্থায় বিভিন্ন ধাতব খনিজ পদার্থের পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ থাকে। তাই ভিত্তিশিলা বিভিন্ন ধাতব খনিজের উৎস হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া মহাদেশীয় ভূখণ্ডের উৎপত্তি, গঠন ও বিবর্তন–সংক্রান্ত গবেষণায়ও ভিত্তিশিলা বিশ্লেষণ করা হয়। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অগভীর ভিত্তিশিলার স্তরে বেশ কিছু কূপ খনন করে ভিত্তিশিলায় কয়লা বেসিন অনুসন্ধান ও সেই বেসিনের ব্যাপ্তি নির্ণয়ের কাজ করেছে। ওই সব কূপের ভিত্তিশিলায় কয়লা ছাড়া অন্য কোনো ধাতব খনিজ পদার্থের উপস্থিতি আছে কি না, সে বিষয়ে এযাবৎ কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি।

কঠিন শিলার অধ্যয়ন এবং তাতে ধাতব খনিজের উপস্থিতি অনুসন্ধান একটি বিশেষায়িত জ্ঞাননির্ভর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে জটিল ও দীর্ঘ। শিলার নির্ভুল শনাক্তকরণ এ প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত, যা নির্ভর করে বিভিন্ন শিলার গভীরতা অনুযায়ী বিশদ বর্ণনা (detailed core logging), সঠিক শিলাতাত্ত্বিক (petrographic) ও ভূ–রাসায়নিক (geochemical) বিশ্লেষণের ওপর। এ ছাড়া বিভিন্ন শিলার কাঠামো বিশ্লেষণ (structural study) ও সেগুলোর আন্তসম্পর্ক (cross-cutting and mutual relations) বিশ্লেষণও ভিত্তিশিলায় ধাতব খনিজের উপস্থিতির সম্ভাব্যতা নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে ভিত্তিশিলা নিয়ে গবেষণা চলছে; গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন দেশি–বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন কঠিন শিলার বিশদ বিবরণ তৈরি ও শিলাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বিভাগের গবেষণাগারেই করা হয়; রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয় জয়পুরহাটের Institute of Mining, Mineralogy and Metallurgy-এর সহযোগিতায়। তবে ধাতব খনিজ ও আইসোটোপ বিশ্লেষণ (isotope study) করা হয়ে থাকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে।

চলমান গবেষণার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রংপুরের বড় পাহাড়পুর অঞ্চলের ভিত্তিশিলায় খনন কূপ জিডিএইচ ৫৪–তে (GDH 54) অল্প পরিমাণ সোনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬৫ মিটার গভীরে অবস্থিত এই ভিত্তিশিলা মূলত ডায়োরাইট। এটাকে ৪৭৮ ও ৪৮৫ মিটার গভীরতায় দুটি হর্নবলেনডাইট শিলা ছেদন করেছে, যাকে ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় বলা হয় হর্নবলেনডাইট ডাইক (dyke)। এই দুটি ডাইকের শিলাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং কোর লগিং (Core logging) পর্যবেক্ষণে ধাতব খনিজের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে অস্ট্রেলিয়ায় ও পরে ফিনল্যান্ডের দুটি গবেষণাগারে অধিকতর পর্যবেক্ষণের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ৪৭৮ মিটার গভীরতার ডাইকটিতে সোনার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ডাইকটিতে সোনা, তামা, লোহা ও সিসার আকরিকের উপস্থিতি রয়েছে, এগুলো বেশির ভাগই সালফাইড গোত্রের। এই গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে, সোনার ভাগ বেশি আছে, এমন অংশটি আছে ভিত্তিশিলার আরও গভীরে। গবেষণাটির জন্য ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া নমুনায় শিলার পরিমাণ কম হওয়ায় এ সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে জিডিএইচ ৫৪ খনন কূপের পূর্ণ গভীরতায় শিলাগুলোর যথাযথ বিশ্লেষণ ও নিকটবর্তী এলাকায় আরও কূপ খনন করে গবেষণা কার্যক্রম চালানো হলে সোনা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের প্রকৃতি, সৃষ্টি ও বিস্তার সম্পর্কে বিশদভাবে জানা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, মধ্যপাড়ায় ভূগর্ভস্থ খনি থেকে যে কঠিন শিলা আহরণ করা হচ্ছে, তা–ও শিলাতাত্ত্বিক বিবেচনায় জিডিএইচ ৫৪ খনন কূপে আবিষ্কৃত সোনার আকরিকের আধার শিলার (host rock) অনুরূপ। কিন্তু যত দূর জানা যায়, মধ্যপাড়ায় ধাতব খনিজ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। এখন এ ধরনের গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মধ্যপাড়া খনিতে পরিত্যক্ত খনন কূপগুলোর দেয়ালের বিভিন্ন শিলার ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র (face mapping), কাঠামোগত অধ্যয়ন ও নমুনা শিলার প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ কার্যক্রম হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এভাবে এসব শিলায় ধাতব খনিজের উপস্থিতির সম্ভাব্যতা প্রাথমিকভাবে যাচাই করা যেতে পারে। এ ছাড়া খনি অঞ্চলের ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন কূপগুলোতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কঠিন শিলার সঠিক প্রকৃতি নির্ণয়সহ ধাতব খনিজ–সংক্রান্ত গবেষণা অনুসন্ধান চালালে মূল্যবান ধাতব খনিজ অন্বেষণের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

লেখক: ড. এস এম মাহবুবুল আমীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কঠিন শিলা ও খনিজবিষয়ক গবেষক

Bootstrap Image Preview