আমি স্যারের সাথে প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি তখন। না, রক্ত-মাংসের স্যারের সাথে নয়, 'চতুরঙ্গ' উপন্যাস পড়ার সময় গিয়াস শামীম স্যার আমাদের 'রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : চেতনালোক ও শিল্পরূপ' বইটা পড়তে বলেছিলেন। এখনো মনে আছে, শামীম স্যার বার বার বলছিলেন, "আকরাম হোসেন নয়, আকরম হোসেন। নাম যেন ভুল না হয়।" কিন্তু, সেই ভুল মনে হয় করব না, করব না করে করে ফেলেছিলাম।
তারপর স্যার রিটায়ার্ড করে চলে গেলেন। আমি বিভাগের অগ্রজদের কাছ থেকে স্যারের গল্প শুনেছিলাম। ক্লাস নেওয়া সহ নানা গল্প। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শরীফ সিরাজ ভাই স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ক্লাসে শিস বাজানোর জন্য কেমন মধুর শাস্তি পেয়েছিলেন। অথবা ভর গ্রীষ্মের দুপুরে ফ্যান বন্ধ করে দরজা আটকে ক্লাস নেওয়ার গল্প শুনেছি বেগম আকতার কামাল ম্যাম, ভীষ্মদেব চৌধুরী, বিশ্বজিৎ ঘোষ, রফিকউল্লাহ খান, সৈয়দ আজিজুল হক, গিয়াস শামীম, সিরাজ সালেকীন, বায়তুল্লাহ্ কাদেরী স্যারদের কাছে। স্মৃতিচারণকারী এঁরা প্রত্যেকেই আমার শিক্ষক। আবার এইসব শিক্ষকদের ছাত্ররাও আমার শিক্ষক। আর এঁদের সবার শিক্ষক সৈয়দ আকরম হোসেন। আমি আসলে পঞ্চম প্রজন্মের একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে নিভৃতচারী স্যারকে স্মরণ করছি, তাঁর জন্মদিনে।
স্যারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল প্রথম তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। কিন্তু ভয়ে সেদিন কথা বলতে পারিনি। কিন্তু কথা বলেছিলাম প্রথম, স্নাতকোত্তর প্রথম সেমিস্টারে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পড়তে গিয়ে। ধবধবে সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা, চুল ব্যাকব্রাশ করা আপাদমস্তক স্মার্ট একজন ব্যক্তি ক্লাসে আসলেন। আমরা ভাবতে পারিনি এই বয়সে এসেও একজন শিক্ষক এভাবে পড়াবেন! কিন্তু সে চিন্তা বাতিল করে দিয়ে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বিষয়ে স্যারের কথার ফল্গুধারা আমাদের চেতনালোককে ছুঁয়ে গেলো, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছিলাম। স্যার ক্লাসে এসে বলেছিলেন যে, আমাদের পরীক্ষার উপযোগী করে লেকচার দিবেন এবং তা লিখে নিতে। কে কী করেছিল জানি না। কিন্তু আমি কথা শুনেছি, পিছে লিখতে গেলে লেকচার শোনা থেকে বাদ পড়ি।
উপন্যাস পড়ার কৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছিলাম, বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথকে একভাবে চিনতাম। স্যারের ক্লাস করে সেই ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। চিন্তার পরিধি ও দ্বার বহুশাখায় পল্লবিত হয়েছিল। আমার মতো নগণ্য একজন মানুষের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়, কিন্তু সমগ্র বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-পাঠকে সম্পূর্ণ নতুন ধারাতে নিয়ে গেছেন সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার । যা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করা উচিৎ, সবাই করেও।
শিক্ষাজীবনে অসামান্য কৃতিত্বের পর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছিলেন শিক্ষকতাকে। বাংলা বিভাগে যোগদানের পর তিনি এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার চেয়ে দায়িত্বটাকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছিলেন । আর শিক্ষকতার সূচনা থেকেই এই বিষয়টা ধারণ করেছিলেন নিজের ভেতরে ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বাংলা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদেরকে হত্যা করা হয়। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষক সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। সে সময়েও তিনি হাল ধরেছিলেন বাংলা বিভাগের। সমস্ত শূন্যতাকে নিজ শ্রম আর ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করেছিলেন। সেই ভালোবাসা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন, এখনো ভালোবাসেন বাংলা বিভাগকে। তাই তো ভোর পাঁচটাতে ঘুম থেকে উঠে নিজের নাস্তা নিজে বানিয়ে উত্তরা থেকে রওনা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সকাল আটটার ক্লাসে ক্লাস নিতে! একদিনও সময়ের হেরফের হয় না তাঁর! প্রথম জীবনে কেমন ছিলেন এই শিক্ষক, তা বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়!
আমরা অনেকে পেশাকে স্রেফ পেশা হিসেবে গ্রহণ করে ক্ষান্ত হয়ে পড়ি, জাগতিক নানা সুযোগ-সুবিধা পেতে ব্যবহার করি পেশাকে। স্যার সেটা করেননি। পড়িয়েছেন সবাইকে সমানভাবে। কিন্তু সেই পড়ানোর মাঝখানে বেছে নিয়েছেন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদেরকে; বিশেষভাবে সাহিত্য-মোদি শিক্ষার্থীদের। যাঁদেরকে বিশেষভাবে গড়ে তুলেছেন বাংলা বিভাগের উৎকর্ষতার জন্য। তিনি বাংলা বিভাগে একটা প্রজন্মের সৃষ্টি করে গিয়েছেন: যাঁরাই এখন হাল ধরেছেন বাংলা বিভাগের; বাংলা বিভাগের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখছেন নিয়তই। আর সেই সুনাম-রক্ষার ভাগীদার স্যারও, তা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন ।
এতো গেল বহুজনের কথা। স্যার নিজে কী ভেবেছেন সাহিত্য নিয়ে? স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সৈয়দ আকরম হোসেনকে আধুনিকতাবাদী সাহিত্য সমালোচনার পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় । ফরাসি সাহিত্যের কল্যাণে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম "আঁভা গ্রাদ" কথাটার সাথে। ঠিক ষাট ও সত্তরের দশকে সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারের সাহিত্য-সমালোচনা ছিল "আঁভা গার্দ" পর্যায়ের। আর তাঁর 'রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: চেতনালোক ও শিল্পরূপ' বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে একটা প্রধানতম কাজ হিসেবেই
পরিগণিত হবে। আর সংকীর্ণ ও আঞ্চলিক সাহিত্য-সমালোচনা থেকে বের হয়ে তাঁর সমালোচনা-সাহিত্যে হয়েছে বিশ্বজনীন-আদর্শ ও স্প্রিচুয়াল-আদর্শে স্নাত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্ব---এই দুইয়ে মিলে তিনি সম্পূর্ণ নতুন ধারার সমালোচনা-সাহিত্যের প্রবর্তন করেন, যা বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে নতুন সংযোজন। যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্ম।
শিক্ষকের প্রধান কাজ ক্লাসে পাঠদান ও গবেষণার প্রতি মনোনিবেশ করা। আর উপযুক্ত হওয়ার পর গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার এ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে ও অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে পালন করেছেন, কোনো খুঁত ছিল নি। বর্তমান কর্পোরেট যুগে এমনটা দেখা যায় ন। সে সময়েও যে এমন শিক্ষক অনেক ছিল তাও বলা যাবে না। টাকাকড়ি এমন ব্যক্তিরা সহজেই করতে পারেন, ক্ষমতা-কাঠমোর মধ্যেও আবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন সহজেই। স্যার তার একটাও করেননি। সত্যি বলতে স্যারের বাসা হওয়ার কথা ছিল ধানমন্ডি বা গুলশানে, কিন্তু স্যারের বাসা উত্তরা, কেন্দ্র ঢাকার সম্পূর্ণ বাইরে!
একটা বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার। যে রাজনীতি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের। কিন্তু, তারপরও ক্ষমতা বা সভাপতির চেয়ার নিয়ে যখন সবাই টানাটানি করছে; স্যার তখন উত্তরার বাসায় নিভৃতে পড়ার চেয়ারে সময় দিচ্ছেন; সভা-সেমিনারের সভাপতি হওয়ার তাড়া তাঁর নেই! সাম্প্রতিক দৈশিক ও বৈদেশিক রাজনীতি নিয়ে তাঁর দৃষ্টিকোণ সূক্ষ্ম; তবুও তিনি টকশোতে যান না। ভালোই করেন, বাকিটুকু নাই বললাম, জানেন-ই তো টকশোতে কী হয়?
বেশ ক'বছর আগের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের রুমে ঢুকতে চেয়েছিলাম, একটা কাজে। কী ব্যবহার পেয়েছিলাম তা আর নাই বললাম! স্যারের কাছেও গিয়েছিলাম, স্যারের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই ক্ষুদ্র মানুষের কথা মনযোগ দিয়ে শুনেছিলেন, সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। কথা বলেছিলেন সাহিত্যের নানা আন্দোলন নিয়ে। কথা বলেছিলেন দৈশিক ও বৈদেশিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে। এমনটা সবাই-ই পেয়ে আসছেন তাঁর কাছ থেকে।
স্যারের জন্মদিন আজ। হয়তো তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি, হবেও না বোধ হয়! আবার হতেও পারে! এই ভূমিতে কতো কিছুই দেখি! শুধু দেখি না আসলে যার দরকার ছিল তা! জন্মদিনে স্যার হয়তো উত্তরার বাসাতেই আছেন, কিংবা বর্ণের সাথে সময় কাটাচ্ছেন।
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন স্যার। জন্মদিনে আপনাকে অসংখ্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সামনের দিনগুলো আরো ভালো কাটুক আপনার, এই শুভকামনা-ই রইলো।
লেখক: "সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়"