Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

বেহুশ বাঙালির হুশ হবে কবে?

ইন্ডিয়ার ডায়েরি-২

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১২:১৮ PM
আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০১:১০ PM

bdmorning Image Preview
ফাইল ছবি


সরোজ মেহেদী।।

ঢাকার আকাশ চিড়ে আমাদের বিমান চলছে। যাচ্ছি কলকাতা, তারপর দিল্লি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। সন্ধ্যার ঢাকা আমার মনে ধরে না। সর্বত্র লাইটের ছড়াছড়ি। দেখে মনে হয় না কোথাও কোন ফাঁকা জায়গা আছে। আন্দাজ করা যায় আকাশ থেকে কোন একটা ফ্লাইওভারও দেখছি। বিমানাবালারা একে একে নানান কিছিমের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন।

বিমানবালাদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। বিমানে চাকরির জন্য দেশের সুন্দরী মেয়েদের নেওয়া হয়। তার ওপর তারা সারাক্ষাণ সেজেগুজে থাকেন। আমি তাই সুযোগটা মিস করি না। ভারতীয় বিমানবালাদের গড়ন আমাদের মতোই। ফলে তাদের পাশে দাঁড়াতে অস্বস্তি হয় না। প্রথমবার বিমানে উঠেছিলাম ইস্তানবুল যাব বলে। টার্কিশ বিমানবালাদের দেখে যতটা না মুগ্ধতা পেয়ে বসেছিল, তার চেয়ে বেশি অস্বস্তি। কী লম্বা লম্বা সব মেয়ে। অধিকাংশ বাঙালিই তাদের কাঁধে পড়ে থাকে।

ঢাকার মানুষ বাংলায় কথা বলে। কলকাতার মানুষও। যাচ্ছি ঢাকা থেকে কলকাতা। অথচ বিমানে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি আর হিন্দিতে। যারা দায়িত্বে আছেন তাদের কাউকেও বাংলায় কথা বলতে দেখলাম না। এখানেই বোধহয় ভারতেরই অন্যান্য অংশ যেমন তামিলদের সঙ্গে বাঙালির পার্থক্য। আমরা নিজেদের মায়ের ভাষার প্রতি আজও যত্নবান হতে পারলাম না। কে জানে একদিন হয়তো এভাবে অবহেলা করতে করতে ভাষাটাকেই হারিয়ে ফেলব। বেহুশ বাঙালির হুশ হবে কবে?

দেখতে দেখতেই চলে এলাম কলকাতা। বাঙালির এক সময়কার প্রধানতম শহর। প্রথম পর্বে বলেছিলাম, ঢাকা বিমানবন্দরে পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে। কলকাতা নেমে মনে হলো, কলকাতার তুলনায় আমাদের বিমানবন্দর নস্যি। নেতাজী সুভাষ চন্দু বসু বিমানবন্দরটি বেশ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও আকারে বড়।

আমি লেখক জাতের কেউ নই। তবু মাঝে মধ্যে লেখকদের সঙ্গে চলাফেরা আছে বলে কদর পাই। কৌতূহল নিয়ে শাহজালালের অন্যপাশের টয়লেট দেখতে গিয়েছিলাম।

রাইসুল নামের ২০-২২ বছরের এক তরুণ টয়লেট পরিষ্কার করছে। আমাকে ছবি তুলতে দেখে, তাকে যেন ভালোভাবে তুলি অনুরোধ করে। আমি কী করব এসব দিয়ে জানতে চায়। টয়লেটের সামনে টিস্যু রাখার স্ট্যান্ড নষ্ট। সে আমার জন্য টিস্যু নিয়ে আসে। তারপর নিজের দু:খের কথা বলে। মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি। থাকা-খাওয়া নিজের।

আমি জানি না এই টাকা দিয়ে তারা কোথায় থাকে আর কী খায়। নিজের পকেট থেকে ওকে যৎসামান্য বকশিশ দিয়ে চলে আসি। কলকাতা বিমানবন্দরে এসে দেখলাম টয়লেটগুলো আমাদের চেয়ে ছোট। তবে এখানে টিস্যু রয়েছে পর্যাপ্ত। হাত শোকানোর ব্যব্যস্থাও আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিক থেকেও তারা আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।

কলকাতার প্রথম অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হলো না। যাত্রা বিরতিতে নামলাম দিল্লি যাব বলে। ইমিগ্রেশন অফিসার আদিবাসী সম্পদ্রায়ের কেউ হবেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলেন। আমাকে ১০ মিনিটের মতো আটকে রেখে নানা রকমের প্রশ্ন করতে থাকলেন। অধিকাংশই অহেতুক। শেষের দিকে জানতে চাইলেন, কনফারেন্সে আমি কি বিষয়ে বক্তৃতা করব? বললাম লেখা আছে পড়েন। তার কথা শুনে মনে হলো না, তিনি কনফারেন্স শব্দটার সঙ্গে পরিচিত।

শেষ দিকে আর স্থির থাকা গেল না, বললাম তুমি কি বলতে পার কেন ইন্ডিয়া-পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যুগ যুগ ধরে গরিব হয়ে আছে। ফ্যাকাশে মুখে পাল্টা প্রশ্ন করল, কেন। আমি বললাম, আমার আর তোমার দিকে তাকাও। আমার কথা শুনে পাশের ইমিগ্রেশন অফিসার হেসে ফেললেন। আমতা আমতা করে বললেন, রাগ করো না এটা আমাদের দায়িত্ব। “মানুষকে কিভাবে স্বাগতম জানাতে হয় সেটা আগে শেখ।” বলে আমি ইমিগ্রেশন পার হই।

ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় এক আন্টি ও তার মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হল। নববিবাহিতা মেয়ে পরশমনি পর্তুগালে যাবে, স্বামীর কাছে। দিল্লি থেকে ভিসা প্রসেস করতে হয়। মা যাচ্ছেন মেয়েকে সঙ্গ দিতে। ইমিগ্রেশন শেষে একসঙ্গে লাগেজ নিতে যাই। তারপর দিল্লীর ডমেসটিক ফ্লাইট ধরার পালা।

বিমাবন্দরে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বদেব মণ্ডল নামে এক তরুণের সঙ্গে কথা হয়। কলেজ স্ট্রিটের পাশের বেড়েই ওঠা তার।পড়াশোনা করেছেন বিদ্যাসাগর স্কুলে। এখন কাজ করেন ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সে।

বিশ্বদেবকে বললাম, তোমরা বাঙালি। আমিও বাঙালি। অথচ আরেকজন বাঙালিকে স্বাগত জানাতে পারলে না। ও হেসে বলে, ইমিগ্রেশনের কথা বলতে পারব না। তবে তোমাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।

লাগেজ চেকিং শেষে কাউন্টার বি তে চলে আসো। বোর্ডিং চেকিংয়ের সময়টা ছিল দারুণ। আরেক বাঙালি সুদীপের সঙ্গে পরিচয় হয়। সুদীপ স্মার্ট তরুণ, কথাবার্তায় খুব ভদ্র। আমি তার সঙ্গে হাত মেলাই। এবার দিল্লী যাবার পালা।

কলকাতা থেকে আমাদের সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছে একদল ভারতীয়। বাঙালি বলা গেল না। যাত্রীদের মধ্যে অবাঙালির সংখ্যাই বেশি। শাহজালালের মতো সুভাষ বসু বিমানবন্দরেও খুব একটা বিদেশী চোখে পড়েনি। আমার বিমানে চেপে বসেছি। বিমানবালারা তাদের হরেক রকম ঘোষণা আর কার্যক্রম শুরু করেছেন। আমার সঙ্গে পরশমনি তার তার মা। চলতি পথের সঙ্গী যাকে বলে।

লেখক: তুর্কি স্কলারশিপ ফেলো। শিক্ষক, ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

Bootstrap Image Preview